৬ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৫

নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের বুকফাটা আর্তনাদ

ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানীরা

সামনে ঈদ। প্রতি বছর ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বঙ্গবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ভিড় জমান খুচরা বিক্রেতারা। গত কিছুদিন ধরে তাই বিকিকিনি চলছিল পুরোদমে। এরইমধ্যে মঙ্গলবার ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলো বঙ্গবাজারসহ চারটি মার্কেট। ভরা মৌসুমে আগুনে সব হারিয়ে পথে বসে গেছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী। একদিন আগেও যে রঙিন কাপড়গুলো মোড়ানো ছিল স্বচ্ছ পলিব্যাগে, সেই সব কাপড়ের রঙ হয়েছে এখন কালো। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে যে বাজার ছিল জমজমাট আজ সেখানে ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার। নতুন কাপড়ের গন্ধের বদলে সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ। আগুনে এক নিমিষে সব শেষ। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর হতাশা চোখে নিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মার্কেটের সামনে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। ধ্বংসস্তূপের পাশে নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা শুধুই আর্তনাদ করছেন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে বিনা সুধে ঋণ চেয়েছেন। এছাড়া পুড়ে যাওয়া মার্কেট থেকে উদ্ধার হওয়া মালামাল লুটের অভিযোগও করেছেন দোকানীরা।

বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুন মঙ্গলবার নিয়ন্ত্রনে আসলেও পাশের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারের আগুন পুরোটা নির্বাপন হয়নি। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও টাওয়ারের ৫ম তলা থেকে শুরু করে ওপরের তলাগুলোতে পানি ছিটাতে হচ্ছিল। বলতে গেলে এখনো সেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে আসেনি আগুন। আগুনে বঙ্গবাজারসহ আশপাশের ৬টি মার্কেটের ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। গতকাল সকালে বঙ্গবাজারে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কোনও মালামাল বেঁচে গেলো কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেকে। ছাইয়ের স্তূপ ঘাঁটছেন তারা। যেখানে আগুনে সব মাল পুড়ে যায়নি, সেখান থেকে ভালো পণ্যগুলো বেছে বের করছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় রাস্তার পাশেই রাখতে হচ্ছে এসব মালামাল। এগুলো নিয়ে অনেককে বেকায়দায়ও পড়তেও দেখা গেছে।

এনেক্সকো টাওয়ারের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম তলা থেকে একের পর এক বস্তা ফেলা হচ্ছে নিচে। অগ্নিকা-ের পর অবশিষ্ট থাকা কাপড়সহ যেসব মালামাল রয়েছে সেগুলো বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির চেনা আবহের মধ্যেও অপরিচিত এক বঙ্গবাজার যেন দাঁড়িয়ে আছে; তার বুকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। বঙ্গবাজার মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটে কুলির কাজ করতেন আক্কাস আলী নামে একজন। তিনি বলেন, এখন ঈদের বাজার, এই সময় এসব মার্কেটে মানুষে গমগম করত। সারা দেশ থেকে বিক্রেতারা পাইকারি মাল নিতে আসত। খুচরা বিক্রিসহ বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা থাকত এসব মার্কেটে। সব দোকানে কাস্টমারদের ভিড় লেগে থাকত, আমরা তাদের মালামাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এনে দিতাম। কিন্তু আজ সব থেমে আছে, চারদিক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্রেতা বিক্রেতার কোনো ব্যস্ততা নেই। আমরাও আজ বেকার, সবার ক্ষতি। এনেক্সকো টাওয়ারের পাশেই অস্থায়ী চায়ের দোকান ছিল সাহাবুদ্দিন মিয়ার। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা লেগে থাকত। কিন্তু আজ সব পুড়ে গেছে, কিছুই নেই, নেওয়ার মতো আর কিছু নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার কারও ব্যস্ততাও নেই। আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে এখানকার সবার। ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই, ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছে আজ। বঙ্গবাজার মার্কেট যখন পুড়ে ছাই, তখন অশ্রুসজল চোখে কার্জন হলের সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ। একপর্যায়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। বুকফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়লেন। শব্দ করে শুরু করলেন কান্না। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমি ভিখারি হইয়া গেছি ভাই, আমার সব শেষ। আমার আর কিছু নাই, আমার শেষ সম্বলও শেষ হইয়া গেছে।’

মালামাল লুটের অভিযোগ: গতকাল পুড়ে যাওয়া মার্কেটের সামনে ব্যবসায়ীরা আসেন কোনও কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা দেখতে। তবে এই সুযোগে সেখানে ঢুকে পড়ে সুযোগসন্ধানীরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, জিনিসপত্র যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নিয়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে, কেউ মাথায় করে, হাতে করে, কাঁধে করে, ভ্যানে করে যেভাবে পারছে ঠিক সেভাবে মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সব পণ্য তাদের নিজের না অন্য কারও, তার কোনও জবাবদিহি নেই। ধ্বংসস্তূপে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিলো এক শিশু। এগুলো নিয়ে কী করবে জানতে চাইলে সে বলে, বেচে দেবো। এমন আরেকজন জসিম মিয়া। মালামালগুলো কার, এভাবে নিয়ে যাচ্ছেন কেন, কোথায় নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, আমি একা নিচ্ছি না। সবাই নিচ্ছে, তাই আমিও নিচ্ছি। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ভুক্তভোগী সালমা বেগম বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে যা দেখলাম এ বিষয়ে আর কী বলবো। দেখতেই তো পারছেন অনেকে এসে জিনিসপত্র খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। এ প্রসঙ্গে চকবাজার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশানার শাহিনুর যিয়াদ বলেন, মালামাল নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যাদেরিই জিজ্ঞেস করেছি তারাই বলছে এখানে তার দোকানে রয়েছে। এজন্য সেভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। যাদের মালামাল তারাও নিচ্ছে। এদের ফাঁকে অন্যজনরাও নিচ্ছে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে বোঝা মুশকিল প্রকৃত মালিক কে।

সরকারের কাছে ঋণ চান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা: ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সরকারের কাছে বিনা সুদে ঋণ সহায়তা চেয়েছেন বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি একই স্থানে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এ আহ্বান জানান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী দিদার মিয়া বলেন, আমার বাড়ির জমি দেখিয়ে ঈদের আগে ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। অন্যান্য মালের সঙ্গে আগুনে আমার তিনটি দোকানের মালামাল পুড়েছে, আমি এখন নিঃস্ব, পথের ফকির। ব্যাংকের কিস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারের কাছে আবেদন, ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য আমাদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হোক। আর এখানে পুনরায় দোকান বসানোর অনুমতি দেওয়া হোক। যাতে যেসব ব্যবসায়ীর গুদামে কাপড় আছে তারা অন্তত সেগুলো বিক্রি করতে পারেন। ১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গবাজারে ব্যবসা করে আসা জুয়েল হোসেন বলেন, জীবনের সবকিছু দোকানে বিনিয়োগ করেছি। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন চলব কীভাবে জানি না। জমি বন্দক রেখে ২৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই টাকা দিতে না পারলে জেলে যেতে হবে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, বিনা সুদে ঋণ দিন।

ব্যবসায়ী নূর আলম বলেন, বঙ্গবাজার ও ইসলামপুর মার্কেট মিলে আমার চারটি দোকান আছে। এখানে দুটি দোকান ছিল। ঈদ সামনে রেখে ৪৫ লাখ টাকার মালামাল কিনেছি। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ১১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। এখন ঋণের এক টাকা দেওয়ার মতোও অবস্থা নেই। সরকারের সহায়তা ছাড়া এ থেকে উদ্ধার পাব না। রাফা গার্মেন্টসের মালিক ফারুক দিদার বলেন, আমার দোকানে ১০ লাখ টাকার বেশি মালামাল ছিল। ক্যাশ ছিল নগদ ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সব পুড়ে ছাই হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, বিকল্প কোনো পথ নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজারের আগুনে ব্যবসায়ীদের দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সরকারের কাছে আমরা সহায়তা চেয়েছি। সরকার আমাদের আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, ক্ষতিপূরণ পাব।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু: বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এই তালিকা করা হচ্ছে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে নাম তালিকাভুক্ত করাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতার পাশাপাশি মার্কেটের জায়গা বুঝে পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল বুধবার বেলা একটার দিকে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের পাশের রাস্তায় যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের নিচে অস্থায়ী বুথ বসিয়ে নাম নিবন্ধনের এই কাজ শুরু করে বঙ্গবাজারের বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি। সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তারা সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলেন। দুপুরের দিকে তালিকার কাজ করা শুরু হয়। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে তালিকা প্রস্ততকারীদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা আদর্শ হকার্স মার্কেট, মহানগরী, বঙ্গ ও গুলিস্তান-এই চার অংশের ব্যবসায়ীরা পৃথক সারিতে দাঁড়িয়ে নাম নিবন্ধনের কাজ করছেন। নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য অনেককে হুড়োহুড়িও করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবকিছু তো শেষ। এখন যদি কোন সাহায্য সত্যিই আসে, তাহলে নাম নিবন্ধন করতে না পারলে তা থেকেও তারা বঞ্চিত হতে পারেন। সেজন্য সবাই চেষ্টা করছেন, যাতে কোনোভাবেই নাম বাদ না যায়। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দোকানের ভিজিটিং কার্ড দেখাতে পারেননি। বলছেন, সবই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে দেশের সব চেয়ে বড় পাইকারি পোশাকের মার্কেট রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আরও কয়েকটি মার্কেটে। সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে প্রায় ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

https://dailysangram.com/post/521386