৬ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৫

সংকটে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা : মাদরাসা শিক্ষা

ড. মো. নূরুল আমিন

॥ গতকালের পর ॥
২. একটি গণতান্ত্রিক সমাজ পরিচালনায় নাগরিক মুল্যবোধ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাদরাসা শিক্ষায় এই নাগরিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় না। ফলে শিক্ষা এবং নাগরিকত্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহী নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা দুর্ভাবনার সৃষ্টি করে।

৩. ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের একটি বিশাল অংশ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় তাদের পাঠ্যসূচি নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী উপরোক্ত তিনটি কারণে ইসলামপন্থী গ্রুপগুলো পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মাদরাসাসমূহের ব্যাপ্তি ও সম্প্রসারণ মৌলবাদের উপকরণ হিসেবে কাজ করছে (Contributing factor to radicalization)। রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের জন্য এই উদ্বেগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কেননা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সাথে তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে শিক্ষাব্যবস্থার কাজ শুধু দক্ষ জনশক্তি তৈরিই নয় বরং সামাজিক মেরুকরণ ও বিভক্তি রোধ করাও যাতে করে দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের গ্যারান্টি থাকে।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে মাদরাসাশিক্ষাকে এই গ্যারান্টির পরিপন্থি বলেই গণ্য করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বর্ণিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় হচ্ছে: ১. সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে ধর্মীয় শিক্ষাখাতের পরিসর অত্যন্ত বড়। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত ২৭৭১৪টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩ শতাংশ সরকার অনুমোদিত আলীয়া মাদরাসা, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মাদরাসায় ছাত্রী ভর্তির হার ছিল নগণ্য, মাত্র ১০ শতাংশ, ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কওমী মাদরাসাসমূহের প্রকৃত তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে আলীয়া এবং কওমী দু’টো মিলিয়ে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় মাদরাসার প্রাধান্য ব্যাপক।

২. দরিদ্র এলাকায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠার হার বেশি। দারিদ্র্যের কারণে অনেক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। মাদরাসাসমূহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকা খাওয়া ও কিতাবপত্র ফ্রি হওয়ায় সেখানে তাদের ছেলে মেয়েদের পাঠানোতে কোনও সমস্যা হয় না। আবার দরিদ্র পরিবার হলেই যে ছেলেমেয়েদের মাদরাসায় ভর্তি করানো হয় তা ঠিক নয়। ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরাও মাদরাসায় ভর্তি হতে দেখা যায়।

৩. আলীয়া মাদরাসাসমূহ তাদের মোট ব্যয়ের বৃহদাংশ সরকার থেকে পায়। কিন্তু কওমী মাদরাসাসমূহের আয়ের ৫৭ শতাংশ আসে যাকাত, ফিতরা, কুরবানির চামড়া প্রভৃতি থেকে, তাদের ৩০ শতাংশ আয়ের উৎস নির্ণয় করা যায় না। আলীয়া মাদরাসার ক্ষেত্রে এ ধরনের আয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৪%।

৪. সহশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ৭৪ শতাংশ কওমী মাদরাসায় সহশিক্ষা নেই, আবার সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ৮০% আলীয়া মাদরাসায় সহশিক্ষা রয়েছে।

৫. সমীক্ষা এলাকায় শতকরা ১০০ ভাগ বেসরকারি মাদরাসায় মেয়েদের জন্য ড্রেস কোড প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে তাদের বোরকা পরতে হয়। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আলীয়া মাদরাসাগুলোর বেলায় ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের বোরকা পরার বাধ্যবাধকতা নেই। ক্লাস রুমের ভিতরে ও বাইরে স্কুলসমূহের ১৮% ছাত্রী, আলীয়া মাদরাসায় যথাক্রমে ৮৫% ও ৮৪% ছাত্রী এবং কওমী মাদরাসার যথাক্রমে ৯৫% ও ১০০% ছাত্রীকে পর্দা করতে হয়। এই বিষয়টিকে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে অনভিপ্রেত গণ্য করে এটি শিক্ষা না সামাজিক ইস্যু সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা মাদরাসাগুলো তাদের রক্ষণশীল সামাজিক ধারণা বিশ্বাসগুলো দরিদ্র পিতামাতা ও অভিভাবকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বলাবাহুল্য আল কুরআনে পর্দা মুসলিম মেয়েদের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি কর্তব্য। মাদরাসাগুলো এই কর্তব্য পালনে ছাত্রীদের সহায়তা করছে। এই অবশ্য পালনীয় পর্দার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে রিপোর্টে একদিকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে পর্দার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে দেয়া হাইকোর্টের রায় মাদরাসাসমূহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্যও উস্কানি দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয়।

৬. গুণগত দিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, ধারাপাত, পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ও ইংরেজিতে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা খারাপ, সমীক্ষাদল কর্তৃক আয়োজিত পরীক্ষার ফলাফলে এই বিষয়টি ধরা পড়ে।
উপরোক্ত অবস্থায় রিপোর্টে সবধরনের মাদরাসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা, মান বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং পাঠক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করা হয়। তাদের এই সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণগুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এই পর্যায়ে একটি কথা বলা দরকার যে, মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং পাশ্চাত্যের অন্য সংস্থাগুলোর যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই। প্রত্যক্ষভাবে হোক কিংবা পরোক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রভুদের প্রভাব, মদদ এবং প্ররোচনায় গবেষণা ও সমীক্ষার নামে এমন কিছু উপাত্ত ও ফলাফল তৈরি করে যা মানুষের মন মানসিকতাকে বিষিয়ে তুলতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার উপর তাদের সমীক্ষা রিপোর্টগুলোকে আমি এই দৃষ্টিতেই দেখি। যে ধারণা বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছে তা শুধু ভিত্তিহীনই নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও। মাদরাসা শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে নাগরিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে না এই ধারণায় যারা বিশ্বাসী শিক্ষা সম্পর্কে তাদের ধারণা যেমন স্থূল তেমনি নাগরিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, অথবা রাজনৈতিক পদ্ধতি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কেও তাদের মধ্যে স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাব আছে বলে মনে হয়। নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে নাগরিক মূল্যবোধের মূলভিত্তি। একটি দেশের নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু অধিকার ভোগ করেন। এই অধিকারগুলো হচ্ছে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং জান ও মালের নিরাপত্তা সংক্রান্ত অধিকার। রাষ্ট্রপ্রদত্ত পরিসেবা ও সুযোগ সুবিধা পাবার অধিকার, আইন আদালতে ন্যায়-বিচার পাবার অধিকার। এই অধিকারগুলোর বিপরীতে নাগকিরদের কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে সময়মত খাজনা ও কর পরিশোধ, ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচন ও সরকার গঠনে সহায়তা, দেশের বিদ্যমান আইন মেনে চলা, অবৈধ কর্মকা- থেকে বিরত থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রতিবেশী বা অপরাপর নাগরিকদের জন্য বিরক্তিকর কোনও কিছু করা থেকে বিরত থাকা, অশ্লীলতা পরিহার করা প্রভৃতি। মাদরাসায় পড়লে এই মূল্যবোধগুলো জন্মায় না এই ধারণা সুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। মাদরাসায় পড়ে ছাত্ররা আলেম হন, কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ ইমামতি করেন, কেউ ঘর গৃহস্থালী কাজ করেন, কেউ সরকারি-বেসরকারি দফতরে চাকরি করেন। আবার অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যও করেন। রাজনীতিও করেন। তাদের মধ্যে নাগরিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়নি অথবা তারা নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন না এ ধরনের নজির বাংলাদেশ কেন দুনিয়ার কোন দেশেই পাওয়া যাবে না। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা, শিক্ষার এই বিভাজন নতুন কোনও বিষয় নয়। ইহুদী, খৃস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ সকল ধর্মাবলম্বীই ধর্মীয় বিষয়ে পা-িত্যসম্পন্ন ব্যক্তি সৃষ্টির জন্য ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকেন এবং এজন্য তাদের স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলে যদি ছাত্ররা নাগরিক মূল্যবোধ বিবর্জিত না হয় তাহলে মাদরাসায় লেখাপড়া করলে হবে কেন? আর আমাদের দেশের যে সাধারণ শিক্ষা তার সংজ্ঞা কি? বৃটিশ আমলে বৃটিশ শাসকরা এদেশে কেরানী নামে কিছু গোলাম তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং এ লক্ষ্যে যে শিক্ষাব্যবস্থা তারা এদেশে প্রচলন করেছিলেন তাই আমরা এখনো অনুসরণ করে চলছি। দু’দুবারের স্বাধীনতা এক্ষেত্রে আমাদের জন্য কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। বৃটিশ শাসকদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল এমন কিছু লোক তৈরি করা যারা রক্ত বর্ণে হবে ভারতীয় তথা এই উপমহাদেশের, কিন্তু জীবনের সকল পর্বে তথা মন-মননশীলতা ও চিন্তা-চেতনায় হবে ইংরেজ তথা পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার ধারক ও বাহক। এই অবস্থায় এদেশের আলেমসমাজ ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রহণ করেননি এবং তার বিকল্প হিসেবে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে বিকশিত করে কুরআন-হাদিস চর্চা, তার প্রচার ও প্রসারকে অক্ষুণœ রেখেছেন। কোটি কোটি মুসলমানের সাহায্য-সহযোগিতা ও একাগ্রতায় তাদের এই প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

মাদরাসায় শুধু দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় এ ধরনের ধারণা ঠিক নয়। সাধারণ শিক্ষা যেমন ধনী ও বিত্তশালীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, তেমনি মাদরাসা শিক্ষাও অভাবী দরিদ্রদের একমাত্র অবলম্বন নয়। দেশে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার উপযুক্ত বিধান না থাকায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে অভিভাবকদের অনেকেই ছেলেমেয়েদের মাদরাসায় পাঠান এবং তারা ইসলামী অরিয়েন্টেশন নিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্রোতধারায় যোগ দেয়। এই সুযোগ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে। শিক্ষার অধিকার সর্বজনীন এবং এক্ষেত্রে কেউ বৈষম্যের শিকার হোক তা কারোরই কাম্য হতে পারে না।

ইসলামী ওরিয়েন্টেশনের কারণে মাদরাসা ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা লাভের বিরুদ্ধে একশ্রেণীর মানুষের বিরোধিতার অন্ত নেই। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল কেয়ারটেকার সরকারের আমলে এই বিরোধিতার প্রকাশ্য অভিব্যক্তি ঘটে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী প্রভাবিত কয়েকটি বিভাগ ২০০৮-০৯ সালের খ ও ঘ ইউনিটের ভর্তি নির্দেশিকা সংশোধন করে একটি পরিপত্র জারি করে। এতে বলা হয় যে, যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক বা সমপর্যায়ে বাংলা ও ইংরেজি প্রতিটি বিষয়ে ২০০ নম্বরের সিলেবাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে শুধু তারাই বাংলা, ইংরেজি, ভাষাতত্ত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জনপ্রশাসন, মহিলা ও জেন্ডার স্টাডিজ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাবেন। আবার অর্থনীতি বিভাগ থেকে অতিরিক্ত শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, ভর্তিচ্ছুদের এইচএসসি বা আলিম পর্যায়ের সিলেবাসে অর্থনীতি থাকতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিকে অর্থনীতির বিকল্প বিষয় হিসেবে গণ্য করা হবে না। এই পরিপত্র জারির পর মাদরাসা বোর্ড থেকে পাস করা এইচএসসির সমমান আলিমের ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু এসব ছাত্রছাত্রীরা মাদরাসা পদ্ধতিতে কারিকুলাম বোর্ড প্রণীত সিলেবাস অনুযায়ী বাংলা ও ইংরেজিতে যথাক্রমে ১০০ মার্কের পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন। হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তরফ থেকে জারিকৃত ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে উভয় বিষয়ের প্রত্যেকটিতে ২০০ মার্ক করে চাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশব্যাপী

বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তির জন্য অতিরিক্ত শর্তারোপ করতে গেল কেন? মাদরাসা ছাত্ররা তো নতুন করে ভর্তি হচ্ছে না; এ বিভাগগুলোতে এর আগেও ভর্তি হয়েছিল। আগের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে তাদের performance কেমন ছিল? যে সমস্ত বিভাগে তারা ভর্তি হয়েছিল সে সমস্ত বিভাগের সেমিস্টার পরীক্ষা বা টিউটরিয়েলে তারা কেমন করেছিল? এতে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ক্ষুণœ হয়েছে? এ প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া দরকার ছিল এবং তা পাওয়াও গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রত্যেকটি বিভাগেই মাদরাসা ছাত্ররা বরাবর ভালো রেজাল্ট করছে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক দশকের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, এ সময়ে এ বিভাগের পরীক্ষায় যারা শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন তাদের মধ্যে মাদরাসা ছাত্রদের আধিক্যই বেশি। ২০০৬-০৭ সালের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আবদুল্লাহ আল আমান নামক যে ছেলেটি প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সে মাদরাসার ছাত্র ছিল।

একইভাবে ঐ বছর ‘খ’ ইউনিটে দ্বিতীয় স্থান অধিকারকারী ছেলেটিও মাদরাসার ছাত্র ছিল। সে ইংরেজি বিষয়ে ৩০ মার্কের মধ্যে ২৮.৫ মার্ক পেয়েছিল। তাদের এই কৃতিত্বের ধারা অধ্যাবধি অর্থাৎ ২০২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। তাদের এ কৃতিত্বের যেখানে স্বীকৃতি দেয়ার দরকার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী ও বামপন্থী কিছু শিক্ষক তা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথই তাদের জন্য রুদ্ধ করে দেন। তাদের ভয় ইসলামী ওরিয়েন্টেশনপ্রাপ্ত মাদরাসা পটভূমির এসব ছাত্র মেধার কারণে ভালো রেজাল্ট করে শিক্ষকতায় আসলে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আধিপত্য শেষ হয়ে যাবে। আবার বিসিএসএ কোয়ালিফাই করে প্রশাসনে আসলে দেশ ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাবে। এ অমূলক আশঙ্কা তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করার যাবতীয় আয়োজন শেষ করে তারা মাদরাসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অভিযানে নেমে যায়। অবশ্য উচ্চ আদালত মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে আরোপিত বিধি-নিষেধ তখন বেআইনি ঘোষণা করেছিল। আদালতে হেরে গিয়ে তারা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদিকে আবার রাজশাহীসহ আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধের নতুন কৌশল অবলম্বন করে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দিয়েও সিওভাক্কি-সজিব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠক্রম আধুনিকায়নের নামে মাদরাসাসমূহের ইসলামী বৈশিষ্ট্য ধ্বংসের পটভূমি তৈরিতে লেগে পড়ে। তাদের সাথে যুক্ত হয় ভারতীয় স্বার্থ। বলাবাহুল্য ভারত সরকারের উদ্যোগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এস. কে সিনহার (যিনি পরবর্তীতে কাশ্মীরের গবর্নর হয়েছিলেন) নির্দেশনায় ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ইলিনইস বিশ্ববিদ্যালয়েরProgram in Arms Control Disazmament and International Security বিভাগের জয়দীপ সাইকিয়া উত্তর-পূর্ব ভারতে মুসলিম মৌলবাদী তৎপরতার ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এই সমীক্ষা অনুযায়ী আসামসহ ভারতের এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে মুসলিম সংগঠনসমূহ উলফা ও অপরাপর ধর্মীয় দলগুলোর ন্যায় ভারত সরকারের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে না এসে অত্যন্ত নিপুণতার সাথে নেজামে মোস্তফা অথবা এমনকি বৃহৎ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে (The Immediate Objective of the (MFOs) Muslim Fundamentalist Organization of India is not to take on New Delhi head on in the manner that the ULFA and Such other ethnic groups are seeking to do, but rather to further the steady Progression towards Nizam-e-Mastafa or ever Brihat Bangladesh)। এতে দেখানো হয়েছে যে, এই রাজ্যগুলোতে বিশেষ করে আসামে মুসলমানদের বার্ষিক সংখ্যা ১৬ শতাংশেরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমীক্ষা রিপোর্টে মুসলমানদের এ সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মৌলবাদী তৎপরতা প্রসারের জন্য মসজিদ-মাদরাসার ভূমিকাকে দায়ী করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইসলামীকীকরণ প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে এও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পাকিস্তানের আইএসআই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতার পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম সংস্থাগুলোকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থ-বিত্ত দিয়ে সাহায্য করছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী জঙ্গিবাদ ও অস্ত্রের পরিচয় দিয়েই মাদরাসাসমূহে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতেখড়ি দেয়া হয়। যেমন বর্ণমালার জীম এর পরিচয় দিতে গিয়ে তাদের জিহাদ (রিপোর্ট অনুযায়ী জঙ্গিবাদ) শেখানো হয়। একইভাবে তা বা তে বলতে তাদের তোপ (কামান), কাফ বলতে কালাশনিকব (রাশিয়ায় তৈরি শক্তিশালী অস্ত্র) এবং খা বা খে বলতে খুন শেখানো হয়ে থাকে। এর অর্থ দাঁড়ায় মাদরাসা ছাত্ররা জন্ম থেকেই জঙ্গি হয়। অস্ত্র আর খুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েই তাদের জিহাদ তথা জঙ্গিবাদের জন্য তৈরি করা হয়।

বিশ্বব্যাংক তার রিপোর্টে যে কয়টি কারণে মাদরাসা শিক্ষা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে: (১) মাদরাসা শিক্ষার নিম্নমান, বিশেষ করে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রদের অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর অবস্থা, (২) মাদরাসা শিক্ষিতদের মধ্যে নাগরিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি। মাদরাসা শিক্ষিতরা রাজনৈতিক পদ্ধতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে না বরং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, (৩) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত মাদরাসা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা সৃষ্টি করছে। কারুর কারুর মতে, মাদরাসাসমূহ জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। (চলবে)

https://dailysangram.com/post/521385