৫ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ১১:১৪

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে সাবেক সচিবের পাঁচ বই কেনার নির্দেশ

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নারে পাঁচটি বই কিনতে চিঠি পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সব বই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সাবেক সচিব মুন্‌শী শাহাবুদ্দীন আহমেদের লেখা।

বঙ্গবন্ধুর ১০০ ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা বাঙালির মুক্তির সনদ, বঙ্গবন্ধুর বাজেট ১৯৭১-১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুর উক্তি সংগ্রহ এবং মানবতার জননী শেখ হাসিনা—এই পাঁচটি বইয়ের মোট দাম ৩ হাজার ১৭৩ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি কলেজ এবং উচ্চবিদ্যালয়গুলোকে বইগুলো কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।

দেশে ৬২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬২৫টি সরকারি কলেজ রয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত এই চিঠি সংগ্রহ করেছেন।

পাঁচটি বইয়ের মধ্যে মানবতার জননী শেখ হাসিনা বইটি ৫৮টি প্রবন্ধ নিয়ে সম্পাদিত বই। একাধিক অসম্পূর্ণ বাক্যে লেখা বইয়ের ভূমিকায় প্রবন্ধ সংগ্রহের কোনো তথ্য উল্লেখ নেই।

২০১২ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বই থেকে অনুমতি ছাড়াই প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর দেওয়া শিরোনাম এটি নয়।
নূহ–উল–আলম লেনিন, লেখক রাজনীতিবিদ, গবেষক
মাউশির চিঠিতে উল্লেখিত বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। জাতীয় ভিত্তিতে কমিটি করে বইয়ের তালিকা করা উচিত বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা।

অনেক বানান ভুল নিয়ে লেখা বইয়ের ‘জনগণমননন্দিত নেত্রী: ভূমিকন্যা’ প্রবন্ধটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদের লেখা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই শিরোনাম তাঁর দেওয়া নয়। তাঁর লেখা কবিতার অংশবিশেষ নিয়ে সম্পাদক নিজের ইচ্ছামতো নাম ব্যবহার করে প্রবন্ধটি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর সবই হয়েছে তাঁর অনুমতি ছাড়া।

‘শেখ হাসিনা গৌরচন্দ্রিকা’ নামে ৭ নম্বর প্রবন্ধের লেখক রাজনীতিবিদ, গবেষক নূহ–উল–আলম লেনিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০১২ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বই থেকে অনুমতি ছাড়াই প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর দেওয়া শিরোনাম এটি নয়।
মুন্‌শী শাহাবুদ্দীন আহমেদের বঙ্গবন্ধুর ১০০ ভাষণ ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে একই নামে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন থেকে এ রকম একটি বইটি প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আবার মহিউদ্দিন আহমেদ খানের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ১০০ ভাষণ বই প্রকাশিত হয়েছিল। একই শিরোনামে আরও কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া মুন্‌শী শাহাবুদ্দীন সম্পাদিত বঙ্গবন্ধুর উক্তি সংগ্রহ বইয়ের ভূমিকায়ও তথ্যসূত্রের উল্লেখ নেই।

২০২০ সালে মুন্‌শী শাহাবুদ্দীন ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বরে মোটরযান ও দ্য বেস্ট অব দ্য লিডার কাট-আউট পেজেজ নামে শাহাবুদ্দীন আহমেদের লেখা অন্য দুটি বই সংগ্রহের জন্য দেশের সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজকে নির্দেশ দিয়েছিল কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

তিনি ব্যক্তিগত কোনো উদ্যোগ থেকে নয়, নির্দেশক্রমে মুন্‌শী শাহাবুদ্দীনের পাঁচটি বই কেনার অনুরোধ-সংক্রান্ত চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন

প্রতিমন্ত্রীর ‘স্বাক্ষর’ করা বই কেনার চিঠিটি তাহলে কার

নিজের বই কেনার জন্য তাঁর অধিনস্থ সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করার বিষয়ে বক্তব্য জানতে মুন্‌শী শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। তিনি ফোন কেটে দেন। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে সেটা দেখেছেন, তবে কোনো উত্তর দেননি।

২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারির চিঠিতে সই করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগত কোনো উদ্যোগ থেকে নয়, নির্দেশক্রমে মুন্‌শী শাহাবুদ্দীনের পাঁচটি বই কেনার অনুরোধ-সংক্রান্ত চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।

বই কেনার তালিকায় এক অতিরিক্ত সচিবের ২৯ বই

বই পাঁচটি ন্যাশনাল পাবলিকেশন নামের একটি প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত হয়েছে। প্রকাশক এইচ এম ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বই পাঁচটি কেনার জন্য মাউশি থেকে চিঠি ইস্যুর বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

মুন্‌শী শাহাবুদ্দীনের এই পাঁচটি বইয়ের মান সম্পর্কে কয়েকটি জেলার শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, সরকারের বড় কর্মকর্তারা ভুলে ভরা বই লেখেন অথবা অন্যের বই কপি করেন আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেগুলো বিক্রি করান। যার কারণে অনেক সময় একই বিষয়ে একাধিক বই কিনতে বাধ্য হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে বই কিনতে বাধ্য করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা এভাবে অনৈতিক কাজ করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও যাদের জন্য এত সব মূল্যবান বই, তারা তো ছুঁয়েও দেখছে না। তাহলে কেন এই অন্যায্য চর্চা?’ এই শিক্ষাবিদের মতে, জাতীয় ভিত্তিতে কমিটি করে বইয়ের তালিকা করা উচিত। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও মনস্বী লেখকেরা সিদ্ধান্ত দেবেন। তাঁরা এমন বই দেবেন, যা শিক্ষার্থীদের জন্য মননশীল।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/eg0lhs9bj4