৫ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ১১:০৫

আগুন নেভানোর আর ব্যবসায়ীদের চোখের পানি একাকার

ফায়ার সাভিসের পানির সাথে চোখের পানি একাকার হয়ে ভেসে গেলো বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন। ঈদের আগে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পাগলপ্রায় কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। কেউ যেন কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। বঙ্গবাজারের ভেতর ভয়াবহ আগুন নেভাতে পানি দিচ্ছিলেন ফায়ার ফাইটাররা। আর বাইরের চার পাশে অঝোরে কাঁদছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাদের চোখের জল যেন ফায়ার সার্ভিসের পানির সাথে মিশে যাচ্ছিল। ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, বছরে ঈদুল ফিতরেই তাদের বিক্রি বেশি হয়ে থাকে। মহামারী করোনার কারণে গত দুই বছর তেমন বিক্রি করতে পারেননি। আশা ছিল এ বছর তাদের বিক্রি হবে। সেই আশায় অনেকে পুঁজির সাথে ঋণ নিয়ে আবার কেউ কেউ স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে কাপড় কিনে রেখেছিলেন বিক্রির জন্য। মুহূর্তের মধ্যে তার সব শেষ হয়ে গেলো। শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, এসব মার্কেটে কর্মরত অর্ধলাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়া এবং বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।

রিয়াজুল গার্মেন্ট, খান ফ্যাশন, এসএ গার্মেন্ট, খান শাড়ি বিতানসহ বঙ্গমার্কেটে ৫টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মো: মামুনের। ঈদ সামনে রেখে ৫টি দোকানে ১০ কোটি টাকার মালামাল তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু আগুনে এক নিমেষে সব শেষ হয়ে গেছে।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, ১০ কোটির টাকার পণ্যের মধ্যে ১ কোটি টাকার মতো বিক্রি করতে পেরেছেন গত কিছুদিন। বাকি পুরো মালামাল দোকান ও গুদামে ছিল। এর মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ টাকার মালামাল রক্ষা করতে পেরেছেন। বাকি সব মাল পুড়ে গেছে। এখন কিভাবে তিনি ঋণ পরিশোধ করবেন, কিভাবে দোকানের কর্মচারীদের বেতন দেবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।

ব্যবসায়ী মামুন বলেন, ‘আমার জীবনের সব উপার্জন যে আগুনে পুড়ে গেল, এই ক্ষতির দায় নেবে কে? কে আমার ঋণ পরিশোধ করবে? আমার তো কিছুই নেই। সব তো শেষ হয়ে গেছে। বঙ্গবাজার মার্কেটে ‘মায়ের দোয়া’ নামে ছয়টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হেলাল খানের। তার দাবি, এসব দোকানে ছয় কোটি টাকারও বেশি মালামাল ছিল। কোনো রকমে একটি দোকানের মালামাল বের করতে পেরেছেন। গুদামের মালামাল বের করতে পারেননি। কিছু পুড়েছে, বাকি সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। হেলাল খান জানান, ঈদ উপলক্ষে তিন কোটি ৭৬ লাখ টাকার মালমাল তুলেছিলেন। সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তাহলে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে পারব। নয়তো আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আল মক্কা গার্মেন্টের কর্মচারী ও তেজগাঁও কলেজের বিবিএর ছাত্র রাহাত কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, এই দোকানে কাজ করে আমার পড়াশোনা চালাই। সেই সাথে সংসার খরচও। সেই দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। চারটা দোকানে কয়েক কোটি টাকার মাল। সব তছনছ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগুনের খবর শুনে সকাল ৭টায় আইছি, ভাবছিলাম ক্যাশ থেকে খাতাটা নেবো। অনেকের লগে দেনা- পাওনা আছে, বাকির খাতা। ঢুকতে দেয় নাই, পরে মাইরা ঢুকছি। এমন সময় ঢুকছি এসি আমার চোখের সামনে বিস্ফোরণ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস তো অনেক চেষ্টা করছে, আগুন নিভাইতে পারে নাই। কেমনে পারব, ওগো কাছে কোনো যন্ত্রপাতি আছে? একটা পানির ট্যাংক আর দুইডা পাইপ আছে। বাইরের দেশে দেহেন কত সুন্দর যন্ত্রপাতি, আগুন লাগলে নিভায়া ফালায়। আগুনে বেলুন নিক্ষেপ করে, আর আমগো এইহানে কিছু নাই। ওগো দোষ দিয়া লাভ নাই। ওগো কাছে যন্ত্রপাতি থাকলে আজকে আগুন নিভাইতে পারত। রাহাত বলেন, মার্কেটের বিদ্যুতের কাট আউট বন্ধ থাকার কথা। যদি সেটা বন্ধ থাকে তাহলে বিদ্যুতের কারণে আগুন লাগল কেমনে। তার দাবি এটা পরিকল্পিত। এইটা পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে।’

ব্যবসায়ী মামুন, হেলাল খানের মতো হাজারও ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে গেছে আগুনে। তাদের মতো সবাই মার্কেটের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের সীমনাপ্রাচীর ঘেঁষা সড়কের ফুটপাথে বসে কান্না করছিলেন। কেউ কেউ আগুন লাগার ঘটনা মোবাইল ফোনে পরিবার-পরিজনকে জানাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন।

রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী কাঁদতে-কাঁদতে মোবাইল ফোনে বলছিলেন, সবার সবকিছু দেখা হয়ে গেছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস আইছে, নৌবাহিনী আইছে, পুলিশ, র‌্যাব সব আইছে; কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এখন আল্লাহর দিকে চাইয়া আছি। আল্লাহ এখন একটু বৃষ্টি দিক। রহম দিয়া সবকিছু ঠাণ্ডা করে দিক। আর কিছু চাই না। কিছুই চাওয়ার নাই। আমাগো সবকিছু শেষ হইয়া গেছে। এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সামনে ঈদ। সন্তানদের কতকিছু কিনে দেব বলে কথা দিছিলাম। এখন আমাগো সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ রহম না করলে আর কিছুতেই কিছু করা যাবে না।’

অনেক কর্মচারীও কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিল্পী ফ্যাশন নামে একটি দোকানের কর্মচারী জাকির হোসেন বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটগুলোতে লাখের ওপরে কর্মচারী রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানের কর্মচারী গত মাসের বেতনও পায়নি। এর মধ্যে আগুনে সব পুড়ে গেছে। এখন মালিক কবে গত মাসের বেতন দেবে সেটাও জানি না। আর ঈদের আগে মার্কেট ঠিক করা সম্ভব হবে কিনা, দোকান আবার খুলবে কিনা সেটাও জানি না। এই অবস্থায় আমরা কিভাবে ঈদ করব বলেন। কিভাবে ঘর ভাড়া দেবো, কিভাবে ছেলেমেয়ে, মা-বাপেরে টাকা পাঠামু?

জাকিরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি দোকানের কর্মচারী হেলাল বলেন, মালিকরা তো আগুনের ঘটনা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। সরকারও তাদের সহযোগিতা করবে। কিন্তু আমরা তো সেটা পারব না। মালিক বেতন না দিলে তো কিছু করার নেই। মালিক যদি বলে, আগুনে সবকিছু পুড়ে গেছে, কিভাবে বেতন দেবো, তখন আমরা কী করব। আবার এখন তো কোথাও চাকরিও পাব না। কিছুই মাথায় আসছে না, কি করব। কিভাবে ঈদ করব পরিবার নিয়ে?

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/739350