৪ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:১৬

কমবে বিদেশি ঋণের ছাড় বাড়বে সুদ পরিশোধে ব্যয়

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রক্ষেপণ

বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের পরিমাণ আগামী তিন অর্থবছরে কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে বেড়ে যেতে পারে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নেওয়া বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের খরচ। এমন শঙ্কার কথা উঠে এসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে আগামী কয়েক বছরের বিদেশি ঋণ-অনুদানের প্রক্ষেপণসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে এমন পরিস্থিতি কাম্য নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০২৩-২৪ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ছাড় প্রাক্কলন করা হয়েছে যথাক্রমে ৯৮৫ কোটি, ১ হাজার ৮৮ কোটি ও ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলার। ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও প্রাক্কলন করা হয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এর আগের অর্থবছরে এটি ছিল ১ হাজার কোটি ডলারের কিছুটা বেশি। এই অর্থবছরেও প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছয় বিলিয়ন ডলার, গত অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৯৫ কোটি ডলার।

এই অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত অর্থবছরের এই সময়ের চেয়ে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ কমে গেছে। গত অর্থবছরের এই সময়ে বিদেশি অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৯০ কোটি ডলার। এ বছর এর পরিমাণ ৪৮৭ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এই অর্থবছর শেষে বৈদেশিক সহায়তার সংগ্রহের পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলারের বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে ইআরডি।

গত অর্থবছর বিদেশি অর্থছাড়ের পরিমাণ বাড়ার কারণ হিসেবে বাজেট সহায়তা বা উন্নয়ন সহায়তার ১৮৪ কোটি ডলার যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এদিকে, কাল বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভা ও সরকারি সম্পদ কমিটির সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের কথা রয়েছে। ওই সভায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সঞ্চয়, মূল্যস্ফীতির হার, সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশকে এখনকার চেয়ে বেশি সুদে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। তাই গ্র্যাজুয়েশনের আগেই কম সুদে বেশি ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানো প্রয়োজন। তবে সক্ষমতার অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণের ছাড় বাড়ছে না। এটি আগের অর্থবছরগুলোর চেয়ে কমে যাওয়া কাম্য নয়।
উল্লেখ্য, অন্য বছরের মতো এবারও বৈদেশিক সহায়তার অংশ খরচ করতে না পারায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধনের সময় এ খাত থেকে বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়েছে।

বিদেশি অর্থছাড়ের প্রক্ষেপণ বিষয়ে ইআরডি বলেছে, বর্তমান পাইপলাইন এবং গত অর্থবছরের ছাড় বিবেচনায় নিয়ে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যৎ বিতরণের যে প্রাথমিক প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা থেকে নমনীয় ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ কমতে পারে এবং ফ্লোটিং রেটযুক্ত ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে।

বৈদেশিক সাহায্যের ছাড় বাড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য ইআরডি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় সভা করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না।
অর্থ বিভাগে পাঠানো ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২০৮ কোটি ডলার এবং ঋণের স্থিতি ৫ হাজার ৯২১ কোটি ডলার।

ইআরডি বলেছে, এই অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের বাজেট বরাদ্দ যথাক্রমে ১৮৪ কোটি ডলার ও ৯৪ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুদ পরিশোধের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

রাশিয়া সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অর্থায়নে ৫০ কোটি ও ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের দুটি ঋণচুক্তি রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় এ প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে রাশিয়া সরকার চিঠির মাধ্যমে জটিলতা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত পরিশোধ স্থগিত রাখতে বলেছে। ফলে এ দুটি ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৩৩ কোটি ডলার অপরিশোধিত রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইআরডি।

বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি খরচ হবে উল্লেখ করে ইআরডি বলেছে, এমআরটি, মাতারবাড়ীসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ পুরোদমে চলছে। এসব প্রকল্পে অর্থছাড় বাড়ছে। ফলে প্রকল্পের গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধও এ অর্থবছর বেড়ে যাবে। এ ছাড়া গত অর্থবছর পাওয়া বাজেট সহায়তার সুদও পরিশোধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে লাইবর ও সোফারের রেট বাড়ায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার কারণেও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়তে পারে।

ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, এই অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে মোট খরচ হয়েছে ১৪২ কোটি ডলার; আগের অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ১৩৩ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বৈদেশিক সহায়তার ছাড় বাড়াতে প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে পুল গঠন, তাঁদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিশ্চিত করা এবং বদলি না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও তার কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বাজেট করার সময় বলা হয় টাকা নেই। বাস্তবে আমাদের খরচ করার সক্ষমতা নেই। বৈদেশিক তহবিলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। কারণ, বিদেশি তহবিল খরচের ক্ষেত্রে অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়, অনেক কাগজপত্র পূরণ করতে হয়। প্রকল্প পরিচালকরা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। টাকা খরচ করতে না পারার কারণে বিদেশি তহবিল ফেরত যাচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়াতে অনেক সিদ্ধান্ত ও আলোচনা হলেও এখানে সফলতা নেই।

তিনি আরও বলেন, বিদেশি তহবিলের খরচ করতে না পারলে উন্নয়নের গতি বাড়ানো সম্ভব হবে না। এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সম্পদ অনেক কম। গতবার অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের তুলনায় বিনিয়োগ কিছুটা বেশি ছিল, যা মূলত বিদেশি সম্পদ। আগামী অর্থবছর থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কিছুটা বাড়তে পারে।

 

https://samakal.com/economics/article/2304165829