৪ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:১২

তরমুজ চাষিদের নীরব কান্না

তরমুজের বাম্পার ফলনে সারাদেশে কৃষকের মুখে ছিল সুখের হাসি। তবে গত মাসের বৃষ্টি তরমুজ চাষিদের মুখের সে হাসি কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে বৃষ্টি আর ফুঁসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পানিতে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে ভোলা সদর, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, বরগুনার বামনা, পাথরঘাটা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াসহ উপকূলীয় কয়েকটি এলাকার তরমুজ ক্ষেতে পানি জমে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন চাষিরা। যে তরমুজ চাষে লাভের আশায় দিন গুনছিলেন, সে তরমুজ পচে নষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্টে ফলানো রসালো এ ফল নষ্ট হওয়ায় লোকসানের কবলে পড়ে নীরবে কাঁদছেন চাষিরা। তরমুজ চাষিদের এই ক্ষতির চিত্র নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট তুলে ধরা হলো।

বরিশাল থেকে নাছিম উল আলম জানান, চৈত্রের মাঝারি থেকে ভারিবর্ষণে এবারো কপাল পুড়ল বিপুল সংখ্যক তরমুজ চাষির। মার্চের মধ্যভাগে থেকে কয়েক দফা হালকা বৃষ্টিপাতের পরে মাসের শেষ ভাগে মাঝারী-ভারিবর্ষণের সাথে ফুঁসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পানিতে বরিশালে তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বরিশাল ও ভোলার মধ্যবর্তী ভেদুরিয়া-শ্রীপুর এলাকায় জোয়ারের পানিতে তরমুজের বিপুল জমিতে প্লাবনের সাথে তেঁতুলিয়া থেকে ১৬ মণ ওজনের একটি বিশালাকায় শাপলা পাতা মাছ তরমুজ ক্ষেতে উঠে অটকা পড়ে মৃত্যুবরণ করে।

বৃষ্টি ও জোয়ারের প্লাবনে অনেক এলাকার চাষিরা মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলনই করতে পারেননি। আবার কিছু এলাকা থেকে উত্তোলিত তরমুজ বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে এলেও তাতে পচন ধরায় সংলগ্ন জেলখালসহ কির্তনখোলা নদীতে ফেলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাষিদের অনেক কষ্টের তরমুজ ভোক্তার পরিবর্তে নদী ও খালে ভাসছে। ফলে আরো একবার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল তরমুজ চাষিদের।

বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, একটানা সপ্তাহখানেক ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বরগুনার হাজার হাজার তরমুজ চাষির পথে নামার উপক্রম হয়েছে। সৌভাগ্যের ফলন তো দূরের কথা ধার দেনা আর ঋণের টাকা শোধ করতেই নাকাল এখন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকাসমূহে কয়েকদিনের ভারিবর্ষণ কৃষক পরিবারে এখন আশা নৈরাশ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলীয় মাটি ও আবহাওয়া তরমুজ চাষের উপযোগী হওয়ায় ক্রমশই তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফার আশার উপকূলের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছেন তরমুজ চাষে। একই সাথে তরুণ উদ্যোক্তারাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন তরমুজ চাষে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর বরগুনা জেলায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তরমুজ ৩০০ কোটি টাকার তরমুজ বেচাকেনা হয়েছে। এবছর ১৭ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে এবং সেখান থেকে উৎপাদিত তরমুজ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজারমূল্যে বিক্রি করার সম্ভাবনা ছিল।

অধিক লাভের আশায় চলতি বছরও কৃষকরা আগেভাগেই তরমুজ চাষের জন্য মাঠে নেমেছিলেন। কেউ কেউ আগাম তরমুজ চাষে বেশ লাভবানও হয়েছিলেন। কিন্তু গতমাসে একটানা সপ্তাহখানেক ভারী বৃষ্টিপাতের আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত সপ্তাহখানেক উপকূলে গড়ে ২০-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি শিলা বৃষ্টিও হয়েছে। শিলা বৃষ্টিতে তরমুজের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরগুনার কৃষি উদ্যোক্তা আবুল কালাম আজাদ ধার দেনা করে ২৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন। তার তরমুজ ক্ষেতে প্রতিদিন কর্মব্যস্ত সময় কাটাতো ৩০ থেকে ৩৫ জন কৃষি শ্রমিক। আর সে ক্ষেত এখন জনশূন্য। টানা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ তরমুজ গাছ। একই ইউনিয়নের আরেক চাষি আবু হানিফ বলেন, এনজিও থেকে চড়া সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ দিয়েছি। একটানা সপ্তাহখানেক বৃষ্টির কারণে তিন ভাগের দুই ভাগ তরমুজ ও গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। এনজিওর ঋণ শোধ করার কোন উপায় দেখছি না।

ভোলা থেকে মো: জহিরুল হক বলেছেন, ভোলার উৎপাদিত তরমুজ স্বাদে অতুলনীয়। যার কারণে দেশ বিদেশে রয়েছে ভোলার তরমুজের ব্যাপক চাহিদা। চলতি মৌসুমে ভোলায় তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও বৃষ্টির কারণে অধিকাংশ ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগেও যেখানে তরমুজ চাষিরা ব্যাপক লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন সেখানে দুই তিন দিনের ভারি বৃষ্টির কারণে সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে চাষিদের। লাভ পওয়া তো দূরের কথা এখন চালানও উঠবে না বলে হতাশায় দিন কাটছে তাদের। এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে চলতি মৌসুমে ভোলা জেলায় তরমুজের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। তবে যারা দেরিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন তারা বৃষ্টির কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

চরফ্যাশন উপজেলার তরমুজ চাষি কামাল উদ্দিন জানান তিনি ১২ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। আর ১০ থেকে ১৫ দিন পরে তিনি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু বৃষ্টিতে তার ক্ষেতে পানি জমে গিয়ে সম্পূর্ণ তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ তরমুজ কাঁচা বিক্রির উপযোগী হয়নি। কিন্তু গাছ মরে যাচ্ছে।

সরজমিনে দেখা যায়, জমিতে জমে থাকা পানি সরানোর চেষ্টা করছেন চাষিরা। ফসল যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ওষুধও দিচ্ছেন; কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কোথাও গাছ মরে যাচ্ছে। কোথাও তরমুজ ফেটে যাচ্ছে। কিংবা পচে যাচ্ছে তরমুজ। এদিকে ধারদেনা করে কিংবা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে যারা তরমুজ চাষ করেছেন তাদের দুশ্চিন্তা বেশি। কীভাবে ঋণ শোধ করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তরমুজ চাষিরা। গত কয়েকদিন ভোলা-লক্ষ্মীপুরের ফেরি বিকল থাকায় তরমুজ ব্যপারিরা ট্রাক বোঝাই করে ঘাটে অপেক্ষা করে থেকে অনেক তরমুজ ট্রাকেই পচে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে ভোলা সদর উপজেলায় ৩৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ৪৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক এম হাসান ওয়ারিসুল কবির জানান জেলায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মোট ১৮ হাজারেরও বেশি তরমুজ আবাদ হয়েছে। ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। কিন্তু আগাম বর্ষার কারণে তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

পটুয়াখালী থেকে মো: জাকির হোসেন জানান, গত ১৫ দিনের বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে পটুয়াখালীতে ৩৬ কোটি টাকার তরমুজের ক্ষতি হলেও পটুয়াখালীর বাজার তরমুজে সয়লাব। ২৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের মধ্যে ১২০০ হেক্টর জমির তরমুজ সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে পটুয়াখালিতে বৃষ্টির চেয়ে ভাইরাসের আক্রমণে এবং নিম্নমানের বীজের কারণে চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পটুয়াখালীর গলাচিপার পক্ষিয়া গ্রামের এক কৃষক বলেন তার ক্ষেতে ভাইরাসের আক্রমণের ফলে গাছ লাল হয়ে তরমুজের ভেতরে শক্ত হয়ে গেছে। এতে ১ কানি জমিতে দেড় লাখ টাকা খরচ করলেও ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পেরেছেন। একই বক্তব্য মৌডুবীর কৃষক মো: তহাসীন হাওলাদারের তিনি জানান, গত বছরে ৪ কানি জমিতে ৭ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করে ১১ লাখ টাকা বিক্রি করেছিলেন; কিন্তু এ বছরে ভাইরাসের কারণে সেই ক্ষেত থেকে মাত্র ১ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন। এদিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে নিম্ন মানের বীজসহ বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণের কারণে শতশত তরমুজ চাষি তরমুজ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে এ এম মিজানুর রহমান বুলেট জানান, কলাপাড়ায় উপকূলীয় এলাকাগুলোতে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তরমুজ ক্ষেতে প্রচুর পানি জমেছে, শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চাষিরা। ক্ষেত থেকে পানি অপসারণ করছে চাষিরা। তরমুজ চাষিরা জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে যে পরিমাণ পানি জমা হয়েছে এতে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। তবে আরো বৃষ্টি হলে ক্ষেত শেষ হয়ে যাবে। বৃষ্টির কারণে গাছে ছোট ছোট তরমুজের বড় তরমুজও করাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। চাষিরা আরো জানান, এবারে সার, বীজ ও কীটনাশকের দাম বেশি থাকায় দিশেহারা কৃষক। আবার তরমুজ আবাদের জন্য অনেক এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ করেছেন। তারা এখন চিন্তিত বৃষ্টিতে তরমুজ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ও একদিকে সারা বছরের জীবন জীবিকার পথরুদ্ধ, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেয়া পুঁজির অর্থ ফেরত দেয়ার দুঃশ্চিন্তায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধানখালী, চম্পাপুর, বালীয়াতলী, ধূলাসার, মিঠাগঞ্জ, কুয়াকাটা, লতাচাপলী তরমুজ বেশি চাষাবাদ হয়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টি রবিশস্যের জন্য কিছুটা উপকারী হলেও সেটা তরমুজ চাষিদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। কয়েক দিন আগেও মাঠে তাকালে শুধু সবুজের সমরোহ ছিল; কিন্তু সেই সবুজ মাঠের মধ্যে এখন শুধু পানি আর পানি। পানিতে ভেসে গেছে কৃষকের মুখের হাসি। তাদের মুখে এখন চিন্তার ছাপ।

চম্পাপুর ইউনিয়নে দেবপুর গ্রামের তরমুজ চাষি মো. শরীফ মিয়া জানান, এবার ৪ কানি জমিতে তরমুজ চাষাবাদ করছি। ‘এনজিও থেকে ঋণ ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে ৬ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করেছি। তা এখন ক্ষেতে পানি জমে আছে। কীভাবে ব্যাংকের ঋণ শোধ করব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে ইমাম হোসেন জানান, এ উপজেলার গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তরমুজ খেতে পানি জমেছে। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চাষিরা। ক্ষেত থেকে পানি অপসারণ করছেন চাষিরা। তরমুজ চাষিরা বলছেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে যে পরিমাণ পানি জমা হয়েছে এতে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। চাষিরা জানান, বৃষ্টির কারণে গাছে ছোট ছোট তরমুজের বড় তরমুজও করাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। তারা জানান, এবারে সার, বীজ ও কীটনাশকের দাম বেশি থাকায় দিশেহারা কৃষক। তরমুজ বিক্রি করে এবার উৎপাদন খরচ না ওঠার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। তাতে, তরমুজ চাষিদের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। লাভের পরিবর্তে লোকসানের শঙ্কায় আছেন চাষিরা।

সরেজমিনে সাহেরখালি ইউনিয়নের দক্ষিণ মঘাদিয়া এলাকায়, অকালে ভারি বৃষ্টিতে কিছুকিছু তরমুজ ক্ষেতে গাছের গোঁড়ায় পানি জমায় গাছ পচে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও তরমুজের গুঁটিতে পানি পড়ায় তরমুজ গুঁটি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে করে লোকসানের মুখে পড়েছে তরমুজ চাষিরা।

https://dailyinqilab.com/national/article/566672