৩ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১:১২

বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে

বৈশ্বিক, ডলার সংকট ও দাম বৃদ্ধির প্রভাব

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিম্নমুখী

বৈশ্বিক মন্দা, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। বিশেষ করে আমদানি রপ্তানিতে পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহণ কমে গেছে। ফলে এসব খাতে পণ্য পরিবহণও কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের জাহাজীকরণ যেভাবে কমেছে, সেভাবে ব্যয় কমেনি। উলটো আয় সামান্য বাড়লে রপ্তানি পণ্য উৎপাদন ও পরিবহণ কমে গেছে। মন্দার কারণে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজার ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে আয় কমেছে। এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। বিনিয়োগ, উৎপাদন কমে গেছে। কর্মসংস্থানের হার নিম্নমুখী।

সূত্র জানায়, দেশের রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বাকি ১০ শতাংশ, মোংলা, বেনাপোল, বুড়িমারী ও অন্যান্য বন্দর দিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত অর্থবছরের অক্টোবর ডিসেম্বরে রপ্তানি খাতের কনটেইনার হ্যাল্ডলিং বা পরিবহণ হয়েছিল প্রায় ২১ লাখ টন। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কনটেইনার পরিবহণ হয়েছে ১৯ লাখ টন। আলোচ্য সময়ে কনটেইনার পরিবহণ কমেছে ২ লাখ টন। অর্থাৎ ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি তো বাড়েইনি। উলটো আরও কমেছে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ।

একই সময়ের ব্যবধানে আমদানির কনটেইনার ২ কোটি ৭৬ লাখ টন থেকে কমে হয়েছে ২ কোটি ৬৫ লাখ টন। আলোচ্য সময়ে কনটেইনার পরিবহণ কমেছে ১১ লাখ টন। আগের বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়নি। উলটো আরও কমে গেছে ৪ দশমিক ০৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুই খাতেই কনটেইনার হ্যাল্ডলিং আগের বছরের অক্টোবর ডিসেম্বরে বেড়েছিল ২ কোটি ৯৭ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে তা কমে ২ কোটি ৮৪ লাখ টন হয়েছে। আলোচ্য সময়ে আমদানি রপ্তানির কনটেইনার পরিবেহণ কমেছে ১৩ লাখ টন। অর্থাৎ গত অর্থবছরের অক্টোবর ডিসেম্বরে বেড়েছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। উলটো তা কমেছে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি যেমন কমেছে, তেমনি আমদানি ব্যয়ও কমেছে। ফলে এসব খাতে পণ্যের পরিবহণও কমেছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি সোয়া ৪ শতাংশ বাড়লেও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশ কম। ফলে সার্বিকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে গেছে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি যেমন বেড়েছে, তেমনি চলতি হিসাবেও ঘাটতি বেড়েছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ভোক্তার আয়। স্বল্প আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম যেভাবে কমেছে, সেভাবে দেশের বাজারে কমেনি। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে চালের দাম প্রতি টন ছিল ৪০০ ডলার। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৪৪৬ ডলার। মার্চে তা কমে ৩৯৮ ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ছিল ১৪৪৬ ডলার। জুনে তা বেড়ে ১৮৮৭ ডলারে উঠেছিল। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে তা কমে হয়েছে ১৫৪৬ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আরও কমেছে। দুবাইভিত্তিক অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেল ছিল গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭৮ ডলার। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫ ডলারে। মার্চে ৭৬ ডলারে নেমেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর দাম কমানো হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শর্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এর দামে সমন্বয় করার জন্য। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে পামঅয়েল প্রতি টন ছিল ১৩০৭ ডলার। গত জুনে তা বেড়ে ১৬৩৪ ডলারে উঠেছিল। মার্চে কমে ৯০০ ডলারে নেমেছে। একই সঙ্গে জাহাজ ভাড়াও কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বরং ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যের দাম আরও বাড়ানো হয়েছে। অথচ ডলারের দাম গত মে থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে বাড়তি দামে স্থিতিশীল রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমায় বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশেও কমছে খুব সামান্য। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ, গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। একই সময়ে ভুটানে মূল্যস্ফীতির ৬ দশমিক ৮৭ থেকে কমে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ হয়েছে। ভারতে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। পাকিস্তানে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ২৪ শতাংশ হয়েছে। ভিয়েতনামে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে।

গত অর্থবছরের অক্টোবর ডিসেম্বর প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশই রপ্তানি হয় আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইনিয়নের দেশগুলোতে। বাকি ২৬ শতাংশ অন্যান্য দেশে। ইউরোপ ও আমেরিকাতে প্রবৃদ্ধি কমছে। বাড়ছে অন্যান্য দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে গত অর্থবছরের অক্টোবর ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ৪১ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে ১৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, উলটো আরও কমেছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ।

অন্যান্য দেশে রপ্তানি ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছে। তবে এসব দেশে রপ্তানি কম।
এর মধ্যে ওভেন গার্মেন্ট ইউরোপের দেশগুলোতে ৩৭ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে। যুক্তরাষ্ট্রে ৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এখন প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, উলটো আরও কমেছে ৭ শতাংশ। অন্যান্য দেশে প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৪ শতাংশ হয়েছে। নিট পোশাক ইউরোপের দেশে ৪৪ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯ শতাংশ বেড়েছিল। এখন রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। উলটো আরও কমেছে ১৯ শতাংশ। অন্যান্য দেশে সাড়ে ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৮ শতাংশ হয়েছে।

গত জুলাই ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১১ শতাংশ। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২টি উপখাতে রপ্তানি আয় কম হয়েছে। ১২টি পণ্যে বেড়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় ১৮টি খাতে কমেছে। বেড়েছে ১৫ খাতে।

একই সময়ের ব্যবধানে আমদানি খাতে এলসি ৩৬ শতাংশ ও আমদানি ১০ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৪০ শতাংশ ও আমদানি ১৫ শতাংশ কমেছে। ভোগ্যপণ্যের এলসি ৩৮ শতাংশ ও আমদানি ১৬ শতাংশ কমেছে। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি ৪৯ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩৮ শতাংশ কমেছে। কিন্তু আমদানি বেড়েছে দশমিক ৩১ শতাংশ। শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি ৬৬ শতাংশ ও আমদানি ৪৭ শতাংশ, বিবিধ যন্ত্রপাতির এলসি ৬০ শতাংশ, আমদানি ৩৭ শতাংশ কমেছে। অন্যান্য পণ্যের এলসি ২৯ শতাংশ ও আমদানি ২ শতাংশ কমেছে।
শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমায় দেশে শিল্প উৎপাদন কমে গেছে। একই সঙ্গে বাজারে ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় এগুলোর দাম বেড়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

সূত্র জানায়, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে এলসির অর্থ পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছে। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন স্বল্পমেয়াদি স্থগিত দেনার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এগুলো এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বেশি হচ্ছে। আয় কম হচ্ছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় গত জুলাই জানুয়ারি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি হয়েছে ৫০৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ২৬ কোটি ডলার। ঘাটতি প্রায় অর্ধেক কমলেও ডলারের ওপর চাপ বেশি। আগে এলসির কারণে চাপ ছিল। এখন চাপ বেড়েছে এলসির বকেয়া দেনা পরিশোধ করতে।

রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছরের জুলাই জানুয়ারিতে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৮৮২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঘাটতি সামান্য কমেছে। তবে আমদানি কমায় শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। কারণ এখন বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই জানুয়ারিতে এ খাতে ঘাটতি ছিল ২০৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৯ কোটি ডলার। ঘাটতি তিন গুণের বেশি বেড়েছে। এতে ডলারের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/661400