৩ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১:০৭

উত্তাল সুপ্রিম কোর্ট

বার নির্বাচন নিয়ে হাতাহাতি, ডিম ছোড়াছুড়ি, পাল্টাপাল্টি শ্লোগান-ধাওয়া

আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, হাতাহাতি, ডিম নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি স্লোগান, কোর্ট অডিটোরিয়ামে তালা, অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়ে সরকার সমর্থকদের দায়িত্ব হস্তান্তরের ঘটনায় গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন উত্তাল হয়ে পড়ে। বেলা ১টা থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের স্লোগান ও পাল্টা স্লোগানে হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এ সময় ডিম নিক্ষেপ করাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

শতাধিক সরকার সমর্থক আইনজীবী এ দিন দুপুরে বার ভবনের সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। তারা সমিতি ভবনে এবং নিচতলায় অডিটোরিয়ামের সামনে বিক্ষোভ করেন। অপর দিকে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরাও সমিতি ভবনের নিচ তলায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন ও সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের নেতৃত্বে কয়েকশ’ আইনজীবী বিক্ষোভ করেন। তারা ভোট চোর ভোট চোর বলে স্লোগান দেন। অন্য দিকে সরকার সমর্থক আইনজীবীরা পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন। এতে আদালত অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে পাল্টাপাল্টি স্লোগান চলে।

এর মধ্যে বেলা ২টায় অডিটোরিয়ামের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, আজ ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে সব আইনজীবী অবস্থান নিয়েছে। তারা সুপ্রিম কোর্টে গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করেছে। এদের বিচার করতে হবে। এই অবৈধ ভোট ডাকাতরা সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র জায়গায় যাতে ঢুুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে আজ সুপ্রিম কোর্টে কিছু করতে দেয়া হবে না। অ্যাডহক কমিটি হয়েছে, এই কমিটিই সমিতির বৈধ কমিটি।

অ্যাডহক কমিটির মতবিনিময় : আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি স্লোগানের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামের সামনে নবগঠিত অ্যাডহক কমিটি মতবিনিময় করে। কমিটির আহ্বায়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মহসিন রশিদ বলেন, বেলা ২টায় আইনজীবীদের সাথে অডিটোরিয়ামে আমাদের মতবিনিময় করার কথা ছিল। কিন্তু তারা চরদখলের মতো তারা চার দিকে তালা মেরে রেখেছে। তালা মারা থাকায় আমরা অডিটোরিয়ামের সামনেই মতবিনিময় করছি। তিনি বলেন, আমরা বেলা ১১টায় বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার এম আমির-উল ইসলামের নেতৃত্বে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করেছি। উনাকে আমরা একটি স্মারকলিপি দিয়েছি। সেখানে আমরা বলেছি, এই অনির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদকের সাথে আপনি কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে কোনোভাবেই তাদের আপনি গ্রহণ করবেন না। আমরা সুপ্রিম কোর্ট বারের অফিসকেও জানিয়ে দিয়েছি। শুধু আমাদের আদেশই মানবেন। অন্য কোনো আদেশ চলবে না। আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার নেতৃত্বে গঠিত সমিতির অ্যাডহক কমিটিই সম্পূর্ণ বৈধ। তারা সমিতির ডিগনিটি নষ্ট করেছে। এ সময় অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব শাহ আহমেদ বাদল, কমিটির সিনিয়র সদস্য গিয়াস উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকশ’ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলন : বেলা আড়াইটায় সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে ল রিপোর্টাস ফোরামের কার্যালায়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে অ্যাডহক কমিটি। এতে কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ মহসিন রশিদ বলেন, বারে যেটা হয়েছে তার নিন্দা জানাই। সমিতির দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় দিয়ে তড়িঘড়ি করে কয়েকজন সদস্য নিয়ে পোনে ২টায় হঠাৎ করে সাধারণ সভা ও দায়িত্ব হস্তান্তরের এমন ঘটনা সুপ্রিম কোর্ট বার প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই ঘটেনি। তিনি বলেন, সাধারণ সদস্যদের তলবি সভায় আজকের এই অ্যাডহক কমিটি। এই কমিটি ছাড়া বারে বর্তমানে আর কোনো কমিটি নেই।

প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়া প্রসঙ্গে বারের সমস্যা সমাধানে তিনি উদ্যোগ নিতে পারেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে মহসিন রশিদ বলেন, প্রধান বিচারপতি এতে ইনভলভ হতে পারেন না। এটা আইনজীবীরাই সমাধান করবেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির সদস্য সচিব শাহ আহমেদ বাদল। এ সময় কমিটির সিনিয়র সদস্য গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মো: নজরুল ইসলাম, ড. রফিকুল ইসলাম মেহেদী, ড. এম খালেদ আহমেদ, তৈমূর আলম খন্দকার, এস এম খালেকুজ্জামান, মির্জা আল মাহমুদ, মো: সাইফুর রহমান, ব্যারিস্টার সরওয়ার হোসেন, ড. শামসুল আলম ও এস এম জুলফিকার আলী জুনু উপস্থিত ছিলেন।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমরা সবাই জানি এবং প্রত্যক্ষ করেছি গত ১৫, ১৬ মার্চ সুপ্রীম কোর্ট বারে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী ভোটার লিস্ট প্রণয়ন করে আগামী ১৪ ও ১৫ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বারের সকল সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বারের সংবিধানের সমস্ত অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং ওই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির নিকট দায়িত্ব অর্পণ করাই এই কমিটির প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। আজকে আমরা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছে চিঠির মাধ্যমে এই অঙ্গীকার পূনর্ব্যক্ত করেছি এবং সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দের নিকট চিঠি প্রদান করেছি।

এতে বলা হয়েছে, আমরা পরিষ্কারভাবে বারের সকল সদস্যদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি আপনারা আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেটা সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য আপনাদের সক্রিয় সমর্থন, সহযোগিতা এবং পরামর্শ একান্তভাবে কাম্য। আর যদি কোনো সদস্য বা সদস্যরা কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন আমরা বিশ্বাস করি তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নির্বাচনের নামে যা হয়েছে তা হচ্ছে পুলিশি তাণ্ডব, কিছুসংখ্যক আইনজীবীর চরম অসভ্যতা এবং নির্বাচনের নামে বারের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। পুলিশি তাণ্ডবে শুধু বারের সদস্যরাই আহত হননি, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুরাও নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। এই প্রসঙ্গে বারের কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি হিসেবে দৃঢতার সাথে বলতে চাই- বেশ কিছুদিন ধরে বারে একটি অশুভ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তা হচ্ছে বারের সদস্যদেরকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করা, কক্ষ ভাংচুর এবং বার প্রাঙ্গণে সদস্যদের নামে অশোভন শ্লোগান দেয়া, এই ধরনের কার্যক্রম অনাকাঙ্খিত, অগ্রহনযোগ্য এবং সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালতের আইনজীবীদের জন্য চরম লজ্জার। বার এই ধরনের কার্যক্রম কোন অবস্থাতেই সহ্য করবে না এবং যদি কেউ এধরনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন তবে তার বিরুদ্ধে বারের সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ৩১ মার্চ বিদায় কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং সাংবিধানিক শূন্যতা পূরনের লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ (৩) (ধ) অনুযায়ী বারের সদস্যরা নির্ধারিত সংখ্যক আইনজীবীদের স্বাক্ষরে সাবেক সম্পাদক আব্দুন নূর দুলালকে চিঠি দেন এবং বারের অফিস ২২ মার্চ তা গ্রহন করে।

উল্লেখ্য, গত ৩০ মার্চ সমিতির সাধারণ সদস্যদের এক তলবি সভা সিদ্ধান্তে বলা হয়, ১৫-১৬ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদকে আহ্বায়ক এবং আইনজীবী শাহ্ আহমেদ বাদলকে সদস্যসচিব করে সুপ্রিম কোর্টবারের ১৪ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়।

এর আগে ১৫-১৬ মার্চ হট্টগোল, হামলা, ভাঙচুর, মামলা, সাংবাদিক পেটানো, প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ ও ধাক্কাধাক্কির মধ্যে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৪টি পদের সব ক’টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছেন। দুই দিনব্যাপী এ নির্বাচনে ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকে ছিল বিএনপি সমর্থকরা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/738887