৩ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১:০৪

মৌনতাই উত্তম

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নরসুন্দরপুরের চৌধুরীদের একসময় বেশ প্রতিপত্তি ছিল। জমি জোতদারি তো ছিলই, ছিল লোক লস্কর, পাইক-পেয়াদার বিশাল বহর। মহিষার মাঠে চাঁদের রাতে তাদের অশ্বারোহীর দল যখন পরের দিন পাশের জমিদার রামজীবনপুরের প্রাণনাথ বাবুর তালুকদারি দখলের লড়াইয়ে নামার মহড়া দিত তখন বোঝা যেত ক্ষমতা ও কুর্নিশের কৌলিন্য কিভাবে সময়ের ¯্রােতে বহমান। হোমনাথ ছিল অশ্বারোহী দলের দলপ্রধান এবং চৌধুরীদের প্রধান প্রতিরক্ষক। তার বিশাল বপু ও পেটানো শরীর মনে করিয়ে দিত শক্তিমত্তা যেন চিরস্থায়ী পত্তন নিয়েছে তার চোখে, চোয়ালে ও দুহাতের কব্জিতে। মনে হতো সে যেন মর্তলোকের অমর্ত্য অবয়বের প্রতীক। কিন্তু কালের কপোলতলে সম্রাট শাহজাহানের পতœী প্রেমের পসার যেমন অমরতা পেয়েও পায়নি তেমনি হোমনাথকেও একদিন কঙ্কালসার হয়েও শ্মশান ঘাটার শবযাত্রায় শামিল হতে হয়েছিল।

বর্ম পরিহিত সশস্ত্র হোমনাথ অনেক দূর পর্যন্ত তার দুচোখ প্রসারিত করে শত্র“র নিশানা ঠাওর করতে পারত। কিন্তু সে তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি নিয়ে দূরদৃষ্টি দূরে থাক- নিকট দৃষ্টিতেও ছিল না। তার মনের জোর তার চাহনিতে, সহিসের লাগাম টানায় কিংবা তরবারির চাকচিক্যের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠত। তার মনে হত অমরাবতির জলে তার মা জননী তাকে যেন সদ্য চুবিয়ে এনেছেন- তার গোটা দেহ অমরার আশীর্বাদ পেয়েছে। হোমনাথের ধরাকে সরাজ্ঞানের কাণ্ডকারখানা দেখে একদিন তার মা ডেকে বলেন, ‘বাছা আশপাশে একটু তাকাস। কেউ কিন্তু একদিনের জন্যও এককভাবে চিরদিনের চরণতলে ঠাঁই পায়নি’। মায়ের কথা হোমনাথের বড্ড বেশি মনে পড়ে সেদিন যেদিন নকিপুরের হরিচরণ বাবুর তীরন্দাজ বলরামের ছোড়া ছোট্ট একটি তীর তার বাঁ হাতের খালি জায়গাটিতে এসে বিঁধে। সেই তীরে বিষ মাখানো ছিল- পচন ধরেছিল সে জায়গায়, সারানো যায়নি হাজার কবিরাজি করেও। হাতের কব্জিসমেত কেটে ফেলেও শেষ রক্ষা হয়নি হোমনাথের। শোনা যায়, মধুমেহ রোগ বাসা বেঁধেছিল হোমনাথের শরীরে। শেষ বয়সে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছিল তাকে। নিজের দেহে বাসা বেঁধে থাকা নীরব ঘাতক এই রোগটি আগেভাগে শনাক্ত করার শক্তি ছিল না হোমনাথের।

হোমনাথেরা একবার জমিদার বাবুর সাথে বাদায় গিয়েছিল। জমিদার বাবু বলেছিলেন, বাদায় বড় মিয়া আছে চলো তার সাথে মোলাকাত করে আসি। তার ধারণা হয়েছিল, শুশ্রুমণ্ডিত কোনো সাঁই বাবা হবেন হয়তো বড় মিয়া যার সাথে কর্তার সম্পর্ক বহু দিনের। হোমনাথ নিজেও মাঝে মধ্যে সাঁই বাবাদের আখড়ায় যেয়ে নিজের মনের খবর নেয়ার কথা ভাবত না যে তা নয়। বিশাল বজরায় তাদের যাত্রা সাত-আট দিনের বনবাস না বন উপভোগের জন্য। হোমনাথ জানে সতীসাধ্বী সীতাকে এই বনেই মায়া হরিণের পাল্লায় পড়ে সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কপালকুণ্ডলার পথিক পথ হারিয়েছিলেন এই বনে। গুম ও অপহরণের কীর্তিকলাপ প্রাচীনকালেও ছিল। হোমনাথ রামায়ণে শুনেছে তাবৎ বানর হনুমানসহ সবাই মিলে রামের সাথে সীতা উদ্ধার অভিযানে গিয়েছিল এবং শেষমেশ সীতাকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল আজকের শ্রীলঙ্কা থেকে। রাবনের লঙ্কার সাথে রামের অযোধ্যার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তখনো ছিল। শেষে হোমনাথেরই দেশের জ্ঞাতিভাই বিজয় সেন নিজে বাংলার মানুষের মহানুভবতা মানবিকতা সব কিছু নিয়ে যান লঙ্কায়। সেখানে থেকেও যান তিনি। ভারত ভূখণ্ডের সাথে লঙ্কার বৈরিতা বরাবর থাকলেও বাংলার সাথে সখ্যতার সোপান গড়েছিলেন বাঙালি বিজয় সেন। এই বিজয় সেনের ছিলছিলাভুক্ত পরবর্তীকালের একজন মহাসেন শ্রীলঙ্কার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও প্রতিপত্তিশালী রাজা হয়েছিলেন- তার দুর্ধর্ষতা ও ধ্বংসপ্রিয়তা শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের পাতায় আছে। সেবার কলম্ব সাগরে জন্ম নেয়া এক ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মহাসেন’ দিয়ে শ্রীলঙ্কাবাসী তাদের ইতিহাসের সেই রাজাকে সমালোচনার পাত্র বানায়। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন প্রবল প্রতাপে বাংলার দিকে এগিয়ে এসেছিল বটে কিন্তু তার চৌদ্দ পুরুষ বিজয় সেনের দেশে সে ততটা ধ্বংসাত্মক হতে চায়নি- যেমনি তার পূর্বসূরি সিডর ও আইলারা করেছিল। এসব ঘটনা হোমনাথের মৃত্যুর প্রায় দেড়-দু শ’ বছর পরের।

জমিদার বাবুর বজরা তেঁতুলখালির খাড়িতে নোঙর করেছিল। হোমনাথ তো ছিলই সাথে ছিল ডজনখানেক পাইক-পেয়াদা, বরকন্দাজ। নোঙর করার পর বিরাট এক বাঘ বাদার দিক থেকে ‘হালুম’ শব্দ করে যখন হুঙ্কার দেয়- দুজন বরকন্দাজ তৎক্ষণাৎ পানিতে পড়ে যায়, পাশে কুমির ছিল তারা হজম করে ফেলে তাদের। জমিদার বাবু জানালেন, ‘বড় মিয়া’ আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। আর তার ভাষা না বুঝতে পেরে পরাণ ও প্রণবরা পানিতে পড়ে গেল! রাম রাম! হোমনাথের সম্বিত ফেরে- সে বুঝল এই ‘বড় মিয়া’ তো সাঁইজির ধারেকাছের কেউ নন। ইনি তো বাদার বড় জমিদার সুন্দর মিয়া। তখন সন্ধ্যা হবে হবে- পশুর নদী থেকে তারা তেঁতুুলখালির খাড়িতে ঢুকেছে ঘণ্টা খানেক হলো। এর মধ্যে এই ‘হুঙ্কার’, জমিদার বাবু যাকে বলছেন ‘অভ্যর্থনা’ আর সেই অভ্যর্থনায় পরাণ-প্রণবের কুমিরের পেটে চালান হওয়া। ব্যাপারটি ভয়ানক! বজরা নোঙর করা হলো- খালপাড় থেকে নিরাপদ দূরত্বে। বড় মশাল জ্বালানো হলো। খালপাড় দেখা না গেলেও খালপাড়ের বড় মিয়ার সাগরেদরা যাতে তাদের শনাক্ত ও সমীহ করতে পারেন তেমন একটি ধারণায়।

জমিদার বাবু সামনের ডেস্কে তার গদিতে বসে নল টানছেন। আজ আর পাখোয়াজের প্রয়োজন নেই-বাদার ও খালের ভাটি থেকে আসা ফুরফুরে বাতাস মৃদুমন্দ সমীরণে নরসুন্দরপুরের জমিদার নারায়ণ চৌধুরীর মনোরঞ্জনের জন্য বেশ বাক্সময় মনে হলো। খোল তবলা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাইজিও এসেছে তিনজন। এই গভীর বাদাবনের খালের মধ্যে নীরব নীশিথে জলসাঘর সাজাবেন রথিকান্ত বাবু-তানসেনের রক্ত নাকি তার ধমনীতে এখনো বহমান।

এখন বসন্তকাল। আকাশে তারা। মৃদুমন্দ বাতাস। ডানে-বাঁয়ে গভীর বাদা। বজরায় রাগ প্রধান গানের রেশ-বাইজিরা নাচছে- এমন সময় একটি উল্লুুক প্রকৃতির পাখি এসে ছোঁ দিয়ে যেন নিয়ে গেল বজরায় বাঁধা একটি জুনিয়র ছাগল। এই ছাগলটি আনা হয়েছে বড় মিয়ার মনোরঞ্জনের জন্য- তাকে ভেট দেয়ার জন্য। এই রাতে এই খালপাড়ে ছোঁ মারার মতো এত বড় উল্লুক বা পাখি কিংবা কিছু কিভাবে এলো কেউ ভাববার আগেই ঘটনাটি ঘটে গেল। জমিদার বাবু আবার ব্যাখ্যা করলেন- ওটা কিছ ুনা, বড় মিয়ার উড্ডয়ন বাহিনী আমাদেরকে একটি ছবক দিতে এসেছিল, আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা দেখতে আর যাওয়ার সময় ছাগলটিকে আগেভাগে ভেট চাইছেন হয়তো বড় মিয়া। জমিদার বাবু রসিকতা করলেন, দেখো না আমাদের নায়েব মশাই- খাজনা আদায়ের আগে নিজে কত পাবেন তার হিসাব কষেন। ‘ও মা জমিদার বাবু এটিও জানেন তাহলে। তিনি তবে কেন এমন নায়েব রাখলেন?’ হোমনাথের মাথায় ঢোকে না। তার পাশে ছিল কূটবুদ্ধি বিভাগের রঘুনাথ বাবু। কানে কানে বলেন, ‘এটি হচ্ছে পরস্পরকে ভেট দেয়ার রীতি’ ‘সেটি কেমন’? ফিসফিস করে জানতে চায় হোমনাথ। রঘু বাবু বলেন, ‘তুমি শুধু তরবারি চালিয়েই গেলে এ টুকু তোমার মাথায় ঢোকে না- আরে নায়েব মশাইয়ের যেমন দরকার জমিদার বাবুর আশীর্বাদ তেমনি জমিদার বাবুরও দরকার নায়েব মশাইয়ের আনুগত্য ও তেলেসমাতি। সে কারণে জমিদার বাবু দেখেও না দেখার ভান করেন নায়েব বাবু যাতে কিছু কামাতে পারেন রায়ত প্রজার কাছ থেকে- নইলে নায়েব বাবু তার পক্ষে কেন অতিখেয়ালি হবেন খাজনা আদায়ে? আরো জানো, প্রজার পয়সা জমিদার বাবুর বেশি বেশি দরকার তার নিজের, পরিবারের ও জ্ঞাতিগোষ্ঠীর হাত তোলার জন্য। সবাইকে হাতে না রাখলে নিজের গদি নিয়ে টানাটানি। এটি এক ধরনের গদি রক্ষার জন্য উৎকোচ বলা যায়। আমাকে গদিনশিন থাকতে দাও- এর জন্য তোমার নিজের পেট যেভাবে ভরতে চাও ভরো আমি কিছু বলব না।’ হোমনাথ শক্তিধর হলেও আসলে মোটা বুদ্ধির লোক। বিষয়টি সে এভাবে ভাবেনি কখনো। মাথায় নানান প্রশ্ন এসে দেখা সাক্ষাৎ শুরু করে দিলো জমিদার বাবুর প্রধান রক্ষকের। রক্ষাপ্রধান হিসেবে হোমনাথ অত্যন্ত বিশ্বস্ত বাবুর প্রতি। সে ভাবে, তাই তো আমার আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য জমিদার বাবু আমাকে অনেক এনাম অনেক সম্মান অনেক সুযোগ দিয়ে রেখেছেন যাতে আমি কখনো বিগড়ে না যাই কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে না পড়ি অথবা জমিদার বাবুর বিরুদ্ধ বাদি বা বিপক্ষ অভ্যন্তর কিংবা বাইরের কারো সাথে যাতে হাত না মেলাই। জমিদার বাবু যথেষ্ট আত্মসচেতন এসব ব্যাপারে। কেননা, তিনি বিচক্ষণ জানেন বড় রক্ষকের মাথা যদি বিগড়ে যায় তাহলে তার নিজের জন্য তো বটে, গোটা জমিদারি হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। আবার মুখ্য রক্ষাকারী হিসেবে হোমনাথ মনে করেন- তার অধীনস্থদের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকা তার নিজের জন্য তো বটেই, পুরো জমিদারির জন্যও তা জরুরি। সে কারণে উপরে জমিদার বাবুর সাথে তার সম্পর্ক এবং নিচে তার অধীনস্থদের মধ্যেও যাতে ঐক্য এবং তার প্রতি আনুগত্য বজায় থাকে, হোমনাথ এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

হোমনাথ বড় একটি মঞ্চে বসা রঘুনাথ বাবুর দিকে ঠায় তাকিয়ে। তিনি ওখানে ওই বাঘটির পাশে বসে রয়েছেন কেন- এ তো ভয়ানক কাণ্ড দেখি। হোমনাথ দেখে বেশ বড় ধরনের একটি হলঘর। চারিদিকে ঘূর্ণায়মান সারিতে বসার জায়গা প্রায় হাজার খানেক পশুপাখি প্রাণীর। মঞ্চে প্রধান আসনে বসা বিরাট সুদর্শন বাঘটিকে হোমনাথের মাঝে মধ্যে জমিদার বাবুর মতো মনে হচ্ছে। সাধারণ একটি বাঘের ধারেকাছে তো দূরের কথা রঘুনাথবাবুর চৌদ্দগোষ্ঠীও চৌদ্দ হাত দূরে থাকতে বাধ্য হবে। অথচ মঞ্চে বাঘটির একপাশে রঘুনাথ বাবু আরেক পাশে একটি সুদর্শন হরিণ বসা। হোমনাথের বিস্ময়ের শেষ হয় না। তার আশপাশে কিচিরমিচির করছে হরেক রকমের পশু পাখি প্রাণী। হোমনাথ বুঝল সে বাদার একটি বড় সম্মেলনে এসেছে। এখানে রঘুনাথ বাবু এবং সে ছাড়া মনুষ্য সমাজের কাউকে দেখা যাচ্ছে না যদিও বাঘটিকে মাঝে মধ্যে তার জমিদাব বাবু বলে মনে হচ্ছে। দুটো বিড়াল এসে হোমনাথের হাতে একটি অনুষ্ঠান সূচির কাগজ দিয়ে গেল। মনে হচ্ছে কয়েক পৃষ্ঠায় লেখা কোনো একটা কিছু। হোমনাথ কিছু পড়তে পারল না। ঠিক এ সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে হলে ঘোষণা এলো- ‘এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সুন্দর মিয়া যিনি বাবাহকুর (বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির) প্রেসিডিয়াম প্রধান’।

ঘোষণা দেয়া হলো- অনুষ্ঠানের প্রধান প্রতিবেদন উপস্থাপনকারী হিসেবে আছেন বাবাহকুতে আপ্যায়িত অতিথি বিশিষ্ট গবেষক ও প্রতিবেশী লোকালয়ের জমিদার চৌধুরী প্রবরের প্রধান কূট পরামর্শদাতা মি. রঘুনাথ। তাকে সুন্দর মিয়া বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন লোকালয় ও বাবাহুকুতে কয়েক শ’ বছর আগেকার মগ সম্প্রদায়ের রাজত্বকালে সেখানকার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে গবেষণা চালানোর জন্য। ঘোষণা শুনে হোমনাথের বুক গর্বে ভরে উঠল এবং তখন তার মনে হলো- বাঘকে মানুষ ভয় পায় খামোখা, বাঘদের সরদার ও এই বাদার স্বঘোষিত রাজ্যের প্রধান সুন্দর মিয়া কত বিচক্ষণ এবং ইতিহাসসচেতন। তিনি রঘুনাথ বাবুকে যেভাবে সম্মান দেখিয়েছেন, নিজের কাছে বসিয়েছেন।

ঘোষণা অনুযায়ী রঘুনাথ উঠে দাঁড়ালেন, পোডিয়ামের কাছে যেয়ে তার নিবন্ধ পাঠ শুরু করলেন। হোমনাথ প্রথমে তার ভাষা বুঝতে পারছিল না এবং তার আশঙ্কা হচ্ছিল এই রঘুনাথ বাবু তাদের সেই রঘুনাথ বাবু তো! এখন তিনি এ কি কোন ভাষায় কথা বলছেন। এর মধ্যে একটি সুদর্শন হরিণ এসে হোমনাথের কানে ফুঁ দিয়ে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল ভাষা। শুনতে পেল রঘুনাথ বাবু প্রাচীনকালে মগ রাজাদের সময়ের কথা বলছেন। রঘুনাথ বাবু একটু বিস্তারিত বয়ানে যাচ্ছিলেন তখন সুন্দর মিয়া পাশে বসা হরিণা হাপানকে ইশারা করে জানাতে বলেন যে, রঘুনাথ বাবু যেন তার গবেষণার সারবস্তুতে সরাসরি চলে যান। রঘু বাবু সারবস্তুতে গেলেন এবং বলেন-

‘মগরাজাদের অন্যতম অধস্তন রাজা ছিলেন পাগালান। তার পিতাও ছিলেন তার চেয়ে বড় রাজা। পাগালান পিতার গর্বিত সন্তান হিসেবে রাজকর্ম পরিচালনা করতেন। এক পর্যায়ে প্রতিবেশীদের পরামর্শ ও কূটবুদ্ধি নিয়ে তিনি রাজ্য অভ্যন্তরে এমন একটি অবস্থা তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন যেন যে কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতে না পারে। ফরমান জারি করা হলো- বাইরের কারো সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করা যাবে না। আর এ সব নিষেধাজ্ঞা দেখভালের ভার এমন ভাড়াদের কাছে দেয়া হলো যে, তারা এর মাধ্যমে এমন এক ভীতির সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো যে, রাজার খয়ের খাঁ হলে সাত খুন মাপ এবং আপন না হইলে তাহাদেরকে সামান্য ছুতা নাতায় দোষী বানানো অব্যাহত রহিল। দেখা গেল আজ যিনি খয়ের খাঁ, বড্ড কাছের জন তিনি বেঁফাস বিরুদ্ধ কিছু বলে ফেললে মুহূর্তের মধ্যে তাকে বাকির খাতায় চলে যেতে হতো। দেখা গেল কোথাও স্বর্পাঘাতে করো মৃত্যু হলেও এই সাপের মন্ত্রদাতা সাজিয়ে শত্র“পক্ষের সবাইকে অভিযুক্ত করা হতো। কর্তাভজার সেই সময়ে ঘাটের পানি আঘাটায় প্রবাহিত হতে লাগল। কে কোথায় কি বলবে তা-ও অনুসন্ধান শুরু হলো। পাগালান মগরাজার এই সব কর্মকাণ্ড দেখে, ভয় পেয়ো, অবরুদ্ধ হয়ো ক্রমে ক্রমে দেখা গেল সেই মুল্লুুকে সবাই কোনো কথা বলা বন্ধ করে মুখে কুলুপ আঁটতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। মগের মুল্লুকে যে মৌনতা দেখা গেল সেই মুল্লুক বেশি দিন যেতে পারেনি’ বলে রঘুনাথ বাবু উপসংহার টানেন। তার বক্তব্য শেষ হলেই মঞ্চের চারিদিকে এক ধরনের শোরগোল শোনা গেল। এতে আনন্দ না প্রতিবাদ প্রকাশ পেল তা বোঝা গেল না।

পাশে রঘুনাথ বাবু তখনো ঘুমাচ্ছেন। হোমনাথ এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে ছিল। ঘোর কেটে গেলে সে বাইরের চিৎকার শুনতে পেল। বজরার পাটাতনে যে খালাসি ও চৌকিদাররা ছিল তাদের একজনের পা কেটে নিয়ে গিয়েছে কুমিরে এই কিছুক্ষণ আগে।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
mazid.muhammad@gmail.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/738753