২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৩২

রাজধানীতে টানা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধের লাগাম

রাজধানীর মহল্লার রাস্তা, অলিগলি, স্কুল-কলেজের গেটসহ বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোর সদস্যদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। আধিপত্য বিস্তারের অংশ হিসেবে এরা চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন, খুচরা মাদকের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, পাড়া-মহল্লায় মারামারি এবং পেশিশক্তির মহড়া প্রদর্শন করে। গত ২২ মার্চ ছোট-বড় দ্বন্দ্বে পটুয়াখালীর বাউফলে কয়েকজন কিশোরের ছুরিকাঘাতে খুন হয় দুই কিশোর শিক্ষার্থী।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এই দুই মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত অন্তত ১০১ জন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছেন। তবে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত এসব কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এরা ফের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়ায়।

সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আরাফাত (১৬) ও আব্দুর রহিম (১৭) নামের দুই কিশোরকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত স্থানীয় একটি কিশোর দলের সদস্যরা। এ ঘটনায় বনানী থানায় ২৫ কিশোরকে আসামি করে মামলা করা হলেও এ পর্যন্ত মাত্র এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে বনানী থানা পুলিশ।
জানা গেছে, কড়াইল বস্তি এলাকার সোহেল, রাফিসহ ২০ থেকে ২৫ জন কিশোর আরাফাত ও আব্দুর রহিমকে ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত এই দুজন বর্তমানে চিকিৎসাধীন। এর আগে ২৭ মার্চ পুরান ঢাকায় এক শিক্ষার্থীর ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় একটি কিশোরদলের সদস্যদের হামলায় আহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) পাঁচ শিক্ষার্থী।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দিন দিন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোর সদস্যদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। এর পেছনে রয়েছে এলাকার রাজনৈতিক দলের কর্মী থেকে কোনো কোনো নেতার মদদ। ফলে এই কিশোররা যেকোনো ধরনের অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে কিশোরদের ফেরাতে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য থেকে জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোরদের অন্তত অর্ধশত গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের প্রতিটির পৃথক নাম রয়েছে। রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও মাদক কারবার, ছিনতাই এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িত এই কিশোররা। রাজধানীতে এদের সংখ্যা অন্তত দুই হাজার। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী। নামের তালিকা ধরে অভিযান চালিয়েও এদের উৎপাত সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

রাজধানীতে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোরদের দৌরাত্ম্য ও তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই সমস্যা শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই এদের উৎপাত রয়েছে। পুলিশ এই কিশোরদের অপরাধ কর্মকাণ্ড দমনে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। এ কারণে এলাকাভিত্তিক এদের নতুন করে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’

সম্প্রতি অপরাধ কর্মকাণ্ডে আটক কিশোর সদস্যরা : গত ১৪ ফেব্রুয়ারি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ১৪ কিশোরকে যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এলাকা আটক করেছে র‌্যাব-১০। এদের মধ্যে ১১ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় মুচলেকা নিয়ে তাদের পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

র‌্যাব-১০-এর অধিনায়ক ফরিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, আটকরা যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর থানার বিভিন্ন এলাকায় পথচারীদের ঘিরে ধরে অস্ত্রের মুখে মানিব্যাগ, টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল, ল্যাপটপ ছিনতাই করে পালিয়ে যেত। এ ছাড়া এরা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে দলবদ্ধ হয়ে সংঘাত সৃষ্টি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করত।

গত ২২ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪৩ কিশোর সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব-২। এর আগে র‌্যাব-২-এর একটি দল ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, হাজারীবাগ, বসিলা ও কারওয়ান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধারালো অস্ত্রসহ ২০ কিশোর সদস্যকে আটক করে।

ত ১৯ মার্চ রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদর দপ্তরে বাহিনীর ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে কিশোর অপরাধ বন্ধ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান।

অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোর সদস্যদের নিয়ে অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। না হয় অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত কিশোরদের দৌরাত্ম্য আরো বাড়বে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় তালিকা তৈরি করে এই কিশোর সদস্যদের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/04/02/1267084