২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:২৪

স্বর্ণের বাজারে কেন এই অস্থিরতা

স্বস্তি নেই সোনার বাজারে। প্রতিনিয়তই ওঠানামা করছে দাম। দাম কমানোর ২৪ ঘণ্টা পরেই ফের বাড়ানো হয়। সোনার ভরি এখন লাখ ছুঁই ছুঁই। দাম বৃদ্ধিতে ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড। প্রতি ভরি এখন ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা। এতে বিপাকে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা।
মূল্যবান এই ধাতুটি এখন তাদের নাগালের বাইরে। এদিকে দাম ওঠা-নামায় শঙ্কায় আছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরাও। তারা জানান, মাসের ব্যবধানে দুই দফা দাম কমায় সোনার বাজারে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল।

তবে তৃতীয় দফায় এক লাফে ভরিতে বাড়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এতে দামের চাপে পিষ্ট হচ্ছে ক্রেতারা। ভুগছেন বিক্রেতারাও। কারণ মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে দেশের বাজারে সোনার চাহিদা কমেছে। ক্রেতাও কম আসছে। আবার অনেকে ঘরে থাকা পুরনো স্বর্ণ বিক্রি করতে আসছেন। কেন সোনার দাম বার বার বাড়ে। সবারই এখন একই প্রশ্ন?
এদিকে শনিবার দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম আরও বাড়ানো হয়েছে। সব থেকে ভালো মানের স্বর্ণের দাম ভরিতে ২ হাজার ৭২৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম হয়েছে ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা। আজ রোববার থেকে সোনার এই নতুন দাম কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।

এর আগে গত ২৪শে মার্চ সোনার দাম বাড়ানো হয়। তার আগে ২২শে মার্চ ও ২৩শে মার্চ দেশের বাজারে সোনার দাম কিছুটা কমানো হয়। অবশ্য তার আগে ১৮ই মার্চ ঘোষণা দিয়ে এক লাফে সব থেকে ভালো মানের সোনার দাম ভরিতে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বাড়ানো হয়। এতে ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম হয় ৯৮ হাজার ৭৯৪ টাকা। ১৯শে মার্চ থেকে সোনার দাম কার্যকর হয়। দেশের বাজারে এতদিন এটাই ছিল সোনার সর্বোচ্চ দাম। রেকর্ড ওই দাম নির্ধারণের চারদিনের মাথায় দু’দফায় সোনার দাম কিছুটা কমানো হলেও এখন দু’দফা আবার দাম বাড়ানো হলো। এতে সোনার দামে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সোনার দাম বৃদ্ধির পেছনে টালমাটাল পশ্চিমা অর্থনীতির ভূমিকা আছে। একের পর এক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ায় বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বেশি পরিমাণ সোনা মজুতের ওপর জোর দিচ্ছে। এ কারণে সোনা কেনার পরিমাণও বেড়েছে। তবে উৎপাদন বাড়েনি। গত বছর ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ সোনা কিনেছে, এক বছরে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১ হাজার ১৩৬ টন সোনা মজুত করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৫০ টন বেশি। তাই সোনার দাম আউন্সপ্রতি ১৪৭ ডলার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা আছে।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে আমিন জুয়েলার্সের ম্যানেজার মকবুল হোসেন বলেন, সোনার দাম বাড়ায় এখন আগের মতো ক্রেতা আসছে না। আমাদের বেচা-বিক্রিও কমেছে। দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দাম বাড়ার নানা কারণ আছে। অনিশ্চিত অর্থনীতি পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। কিন্তু অনিশ্চয়তার সময়টাই আসলে সোনার স্বর্ণসময়। যত বেশি অনিশ্চয়তা, ততবেশি সোনা বিক্রি। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার দাম বৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েই সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যখন অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়, তখন স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। আবার মুদ্রাস্ফীতি হলেও সোনার দাম বাড়ে। বিশ্বব্যাপী এখন ভয়ঙ্কর মুদ্রাস্ফীতি চলছে। তাই সোনার দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। সোনা হচ্ছে একটি নিরাপদ ধাতু, এটা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এ কারণে বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা শুরু করেছে। আর্থিক নিরাপত্তার কারণে তারা সোনার মজুত বাড়াচ্ছে। এজন্য সোনার একটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে হু হু করে দাম বেড়ে গেছে। আর জ্বালানি তেলের কেনাবেচার সঙ্গেও সোনার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সোনার দামও বেড়ে যায়। কারণ, তখন অনেক দেশই সোনার বিনিময়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে। আর যেহেতু এখন ডলারের কারণে বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে সোনার চাহিদাও বাড়ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাহকরা ছোট ও মধ্যম সারির ব্যাংক থেকে আমানত তুলে বা সরিয়ে নিতে শুরু করেন। ব্যাংকে টাকা না রেখে সোনা কেনা শুরু করে। এটাও দাম বাড়ার কারণ।

বাজুস’র মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়বে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সোনার দাম বাড়ার এবারের কারণটা কিছুটা ভিন্ন। তা হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। মূলত এ কারণেই এবার বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম দুই হাজার ডলার না ছাড়ালেও দেশে প্রতি ভরির দাম লাখ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়াল বলেন, বাংলাদেশে সোনা তৈরি হয় না। সোনা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক রয়েছে। তাই সোনার দাম বাড়ার একটি কারণ হলো ডলারের দাম বৃদ্ধি। আবার পশ্চিমা ব্যাংক খাত নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছে। এজন্য নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনা কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজুস’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে তেজাবী সোনার দাম বেড়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে, যা ২রা এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। নতুন মূল্য অনুযায়ী, সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম ১ হাজার ৫১৬ টাকা বাড়িয়ে ৯৯ হাজার ১৪৪ টাকা করা হয়েছে। দেশের বাজারে এর আগে কখনো এক ভরি সোনার দাম ৯৯ হাজার টাকা হয়নি। এ ছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ১ হাজার ৪৫৮ টাকা বাড়িয়ে ৯৪ হাজার ৬৫৩ টাকা করা হয়। ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ১ হাজার ২২৫ টাকা বাড়িয়ে ৮১ হাজার ১২৩ টাকা করা হয়। আর সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৭ হাজার ৫৯৩ টাকা করা হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=49420