২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:১২

আগের বছরের তুলনায় সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৭২ শতাংশ ছাড়িয়েছে

সরকার যদি অব্যাহতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে থাকে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। অবশেষে সত্য হলো অর্থনীতিবিদদের সেই শঙ্কা। সেটা অনুধাবন করে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অর্থনীতিতে চলমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ বিবেচনায় রেখে সরকারকে আগামী দিনে ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর জোর দিতে হবে। কেননা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি মেয়াদে আগের বছরের তুলনায় সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকায়। যার বড় একটি অংশ এসেছে ব্যাংকিং খাত থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার তাদের কাছ থেকে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে নতুন ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

এই প্রক্রিয়া মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ বাজারে গেলে পরবর্তীতে টাকার পরিমাণ ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘মানি মাল্টিপ্লায়ার’ বলা হয়। ফলে সরকার যে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে এর পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এই নতুন টাকা সরবরাহের বিপরীতে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত অর্থ পণ্যের চাহিদা তৈরি করবে, যার ফলে দ্রব্যমূল্যও বাড়বে।

বর্তমানে সেটিই ঘটছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের বর্ধিত মূল্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে প্রায় ১ বছর ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কমানোর এই সুপারিশ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.৭৮ শতাংশে পৌঁছে, যা গত ৫ মাসের পতনের ধারাবাহিকতা ভেঙে দেয়। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ, নবেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর গত আগস্টে এটি ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯.৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।

এই আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর আগেই বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি ঋণ হিসেবে অর্থনীতিতে এই নতুন অর্থের সরবরাহ শিগগির মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। কিন্তু সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে আগামীতে তা মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ এর ফলে সামনে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে আসবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাত থেকে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মাসে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২১-২২ সালের একই সময়ে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। জুলাই-জানুয়ারি মাসে দেশের ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাত থেকে মোট ঋণ নেওয়া হয়েছিল ৩ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯.৩ শতাংশ। ২০২২ অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ১৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, সরকারের অধিক ঋণ গ্রহণের ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের ঋণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে আসে। যেখানে সুদ পরিশোধ বাবদ সরবকারের ব্যয় বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা গেছে, ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ সরকার ২৭ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০২৩ অর্থবছরে সরকার ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করে দেশি-বিদেশি উভয় ঋণের জন্য। সংশোধিত বাজেটে সেটা বাড়িয়ে ৯০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আরও ১ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার তীব্র অবমূল্যায়ন এবং ট্রেজারি বিলগুলোর উচ্চ ব্যয়ের কারণে অর্থবছরের প্রথমার্ধে সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় প্রায় ২২ শতাংশ বেড়ে ৪০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা হয়েছে। জাহিদ হোসেন জানান, ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণ এবং ব্যয়বহুল ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের ঋণের বাজেট ঘাটতি কমাতে সরকারের ২টি বিকল্প রয়েছে, তা হলো- হয় রাজস্ব বাড়াতে হবে, না হলে ব্যয় কমাতে হবে।

এদিকে তারল্য সংকটের কারণে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে সরকার। মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে সরকারের। এই প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে না নিয়ে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

https://dailysangram.com/post/521002