২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৪

হাওরে আর্তনাদ

উজানের ঢলের পানি ও আগাম বন্যায় ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে হাওরাঞ্চলের আধাপাকা ধান। কদিনে পানির নিচের কাঁচা ধান পচে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস হয়ে গেছে হাওরের পানি। তৈরি হয়েছে উৎকট দুর্গন্ধ। এতে মরে ভেসে উঠছে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার শতাধিক হাওরের মাছ। এবার সেই বিষাক্ত গ্যাসে মরছে হাঁস, পাখি, সাপ, ব্যাঙসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। সোনাফলা ফসল হারানোর পর মাছ মরে যাওয়ায় হাহাকার করছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। তাদের এই আর্তনাদ শোনার যেন কেউ নেই। এদিকে হাওরের বিষাক্ত মাছ না খাওয়ার জন্য এলাকায় এলাকায় করা হচ্ছে মাইকিং। দূষণ রোধে হাওরের পানিতে ছিটানো হচ্ছে চুন। মাছ ধরার ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। জীবিকা হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা।

ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে জানান, হাকালুকি হাওরে মরা পচা মাছ ও পোকা খেয়ে মরছে পোষা হাঁস। হাওরে
হঠাৎ মাছের মড়কের পর এখন মরছে হাঁস আর জলজ প্রাণি। হাওরজুড়ে বোরো ধান হারানোর পর এখন একের পর এক দুর্যোগে দিশেহারা হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী লোকজন। গতকাল সরজমিন হাকালুকি হাওরের কয়েকটি বিল ঘুরে ও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল তাদের এমন অসহায়ত্বের কথা। তারা জানালেন সম্প্রতি কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পচে যায় থোড়ওলা ও আধপাকা বোরো ধান। পচা ধানে হাওরের পানি দূষিত হয়ে নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা ও পোনামাছ মরে পচে হাওরের পানিতে ভাসতে থাকে। মাছের পাশাপাশি সাপ, ব্যাঙ, শামুক, জোঁক ও পানিপোকা মরে ভেসে উঠছে। আর এসব পচামাছ ও জলজ প্রাণিগুলো খেয়ে মারা যাচ্ছে হাঁস। গত দুদিনে হাকালুকি হাওরের ফেঞ্চুগঞ্জ ঘিলাছড়া অংশে মারা যায় কয়েক শ’ হাঁস। ওই এলাকা ছাড়াও হাওরের অন্যান্য এলাকায়ও হাঁস মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। স্থানীয়রা জানান, বাতাসে মরা পচা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণিগুলো ঠেলে তীরের দিকে নিয়ে আসে। আর ওই সব তীরবর্তী এলাকার হাঁস এ মরা পচা মাছ ও জলজ প্রাণি খেয়েই মারা যায়। হঠাৎ হাঁসের এমন মড়কে উদ্বিগ্ন হাওর পাড়ের ছোট-বড় খামারিরা। তবে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী খামারের হাঁসগুলো নিরাপদে রাখতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন তারা। এ কারণে নতুন করে এখন হাওর তীরের কোনো হাঁসের খামারে মড়ক লাগেনি। ধান আর মরা পচা মাছের দুর্গন্ধে হাওর তীরের বাসিন্দারা এখন অস্বস্তিতে। হাওরের চিরচেনা সফেদ পানি এখন কালছে ও লালবর্ণ ধারণ করেছে। পানিতে অসহ্যনীয় দুর্গন্ধ। এ কারণে এখন খাবার পানিসহ প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছেন তারা। সরজমিন হাওরের কয়েকটি বিলে দেখা গেল জেলেরা জাল দিয়ে মরা মাছ সংগ্রহ করছেন শুঁটকি দেয়ার জন্য। কিন্তু গেল শনি, রবি ও সোমবারের মতো এখন আর মরা মাছ মিলছে কম। কারণ হিসেবে জেলেরা জানালেন, বাতাস আর বৃষ্টিতে ঠেলে মরা মাছ তীরের দিকে নিয়ে গেছে। অনেক মাছ পানির নিচে কাঁদায়ও আটকে পড়েছে। মৎস্য বিভাগ থেকে হাওরে ৩ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হলেও কয়েকটি বিলে লুকিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেল অনেক জেলে দল কে। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও তাদের জালে ধরা পড়ছে না কোন মাছ। অনেকেই তাই জালগুটিয়ে মাছ ছাড়াই খালি হাতে ফিরতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই জেলেরা জানালেন পেটের দায়ে পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে বন্ধ ঘোষণার পরও লুকিয়ে মাছ ধরতে নেমেছিলেন। কিন্তু একটি মাছও জালে ধরা পড়েনি। ধান নেই মাছও নেই। এখন খাব কী। আর পরিবারপরিজন নিয়ে বাঁচব কিভাবে। তাদের মতো পুরো হাওর পাড়ের মানুষের মধ্যে এখন শুধুই হাহাকার। এবছর অকাল বন্যায় কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষগুলো ধান ও মাছ হারিয়ে নির্বাক। একসঙ্গে ধান, মাছ ও জলজ প্রাণির মড়কের আগে কখনো দেখেনি তারা। মিরশংকর ও সাদিপুর, মহেষগরি, গৌড়করণ এলাকার আব্দুল মতলিব, বছির মিয়া, সুজাত মিয়া, আজির আলী, বদর উদ্দিন, লিচু মিয়া, শামীম মিয়া, দুদু মিয়া, সামরুল ইসলাম, তৈইমুছ আলী, ছানা মিয়াসহ অনেকেই জানান তারা মহাজনের কাছ থেকে (আগাম ধান বিক্রি করে) টাকা নিয়ে ও এনজিও থেকে উত্তোলিত ঋণের টাকা দিয়ে বোরো ফসল চাষ করেছিলেন। এখন বোরো ধানও নেই মাছও নেই। তাই কী দিয়ে ঋণের টাকাগুলো পরিশোধ করবেন আর নিজেদের সংসার চালাবেন- এমন চিন্তায় মাথা ঘুর পাক খাচ্ছে। ওই টাকার জন্য পাওনাদাররা বারবার তাগিদ দিচ্ছে। সেই ঋণ এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় বোরো আবাদ হয়েছিল ৫৩ হাজার ৪২৬ হেক্টর। এর মধ্যে পানিতে নিমজ্জিত হয় ১৭ হাজার ৪৩২ হেক্টর বোরো ফসলের জমি। পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যায় ১০ হাজার ২২৬ হেক্টর ফসলি জমি। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩০ হাজার ৮৩০ জন। পানিতে তলিয়ে যাওয়া বোরো ধানের ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয়েছে ১১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। হাকালুকি হাওরের চকিয়া ও নাগুয়া বিলের ইজারাদার আনোয়ার হোসেন ও আব্দুর রব কামাল বলেন, বিলগুলোয় কোটি টাকার বিনিয়োগ হঠাৎ মাছের মড়কে আমাদের সবশেষ। হাকালুকিতে মাছের মড়কে প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারেও। বাজারগুলোতে হাকালুকি হাওরের মাছ না ওঠায় মাছের দামও চড়া। হাকালুকিতে মাছের এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে চরম সংকট দেখা দেবে বলে জানাচ্ছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায় হাকালুকিতে মাছ ও জলজ প্রাণির মড়ক ও পানির দূষণ বন্ধে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে ১৮ই এপ্রিল (মঙ্গলবার) থেকে ছিটানো হচ্ছে চুন। মঙ্গল ও বুধবারে বৃষ্টি আর ছিটানো চুনে পানির অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ.ক.ম শফিক উজ জামান মানবজমিনকে বলেন, ছিটানো চুন আর বৃষ্টিতে পানির অবস্থা ভাল হচ্ছে। প্রতিদিনই হাওরের পানি ও মাছের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আশা করছি ২-৩ দিনের মধ্যে পানির অবস্থা আরো ভালো হবে। পানি ভালো হলে বিল নার্সারির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে পোনা মাছ ছেড়ে হাওরের মাছের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্ঠা অব্যাহত থাকবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাজান বলেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দেবে কৃষি বিভাগ। ক্ষতি পোষাতে আউশ ধান গত বছরের চেয়ে এবছর (গত বছর ৪২-এবছর ৪৭ হাজার হেক্টর জমি) ৫ হাজার হেক্টর বেশি জমি আবাদের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বড়লেখা (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওরে পানি দূষণের ফলে মাছ, পাখি, হাঁস বিভিন্ন্ন প্রজাতির প্রাণী মরে যাচ্ছে। প্রশাসনের উদ্যোগে হাওর অঞ্চলের বিলগুলোতে পানি দূষণমুক্ত করতে ছিটানো হয়েছে পাঁচ টন চুন। জানা যায়, পানি দূষণের ফলে বিষক্রিয়ার ফলে হাওরে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এতে হাওর পারের বিশ সহস্রাধিক জেলে জীবিকা নির্বাহ করতে দিশে হারা হয়ে পড়ছেন। আগাম বন্যায় হাকালুকি হাওরের ২৫ হাজার হেক্টর বোরো ফুল আসা ধান পানিতে তলিয়ে যায়, এতে করে পানি দূষণ হয়ে মা মাছ ও পোনাগুলো মরে যায়। এতে করে মৎসজীবীরা জানান, এ বছর হাওরের মাছের আকাল দেখা দেবে। পানি দূষণের ফলে সহস্রাধিক হাঁস বিভিন্ন প্রজাতির পাখি মারা যায়। দূষিত পানি ও পচা মাছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টির আশংকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে মাছ না ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর গত দুইদিন ধরে পানির নিচে থাকা ধান গাছ পচে পুরো হাওর এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি হাওরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীও মরে পানিতে ভেসে উঠেছে। এতে করে হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা বর্ষা মৌসুমে ওইসব হাওরে জাল দিয়ে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহের শেষ অবলম্বনটুকুও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। জানা গেছে, অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকের কাঁচা ও আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর হাওর পাড়ের অনেক কৃষকই বর্ষা মৌসুমে হাওরে জাল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু গত দুইদিন ধরে ওই দুই জেলার পানিতে তলিয়ে যাওয়া সবক’টি হাওরের পানি থেকে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং পানিতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছসহ জলজ প্রাণীও মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছে। মৎস্য গবেষকদের মতে ওইসব হাওরের পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া ধান পঁচে পানিতে অক্সিজেনের লেভেল ১ পিপিএম’র নিচে ও অ্যামোনিয়ার মাত্রা বেড়ে শূন্য দশমিক পাঁচে ওঠার কারণেই হাওরের পানিতে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরে ধান পচে বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাচ্ছে মাছ। বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ না খাওয়ার জন্য ওসমানীনগর উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। জানাযায়, অকাল বন্যা ও অতি বৃষ্টিতে জেলার বিভিন্ন হাওরে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় পর পানির নিচে থাকা ধান পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাওরের মাছগুলো মরে পানিতে ভেসে উঠছে। মাছ মরে পচে যাওয়ার ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন এসব মাছ না খাওয়ার জন্য উপজেলাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করেন। ওসমানীনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুুস সালাম জানান, পানিতে ধান পচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হওয়ায় সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার হাওরে মাছগুলো মরে পানিতে ভেসে উঠেছে। ওইসব মাছ আহার করলে ক্ষতি হতে পারে এমন আশংকায় আমরা সচেতনতামূলক মাইকিং করেছি। আক্রান্ত মাছগুলো না খাওয়ার জন্য।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=62334