১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১০:৫৯

শিল্প খাতের উৎপাদনে বড় বিপর্যয়

গত প্রায় এক বছর শিল্প খাতের মৌলিক উপকরণ-ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের সংকট চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশেও। এর ধাক্কা লেগেছে শিল্প পণ্য উৎপাদনে। এক বছরের ব্যবধানে এসব পণ্যের ২২টি খাতের ১৩টিতে উৎপাদন কমেছে। যেখানে আছে খাদ্য, বস্ত্র, চামড়াসহ বড় সব খাত। আর এগুলোর মধ্যে ৭টিতে আলোচ্য সময়ে গড়ে উৎপাদন বাড়েনি। বরং কমে নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। যার প্রভাবে বাজারে খাদ্যসহ সংশ্লিষ্ট দেশীয় পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বেড়ে গেছে দাম। একই অবস্থা আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও। এসব পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। তবে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ৯টি খাতে উৎপাদন বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে শিল্প পণ্যের উৎপাদন প্রায় তিনগুণ কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ খাতে উৎপাদন বেড়েছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। ওই সময়ের ব্যবধানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে ৯ শতাংশ। উৎপাদন কমার তালিকায় মানুষের ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সামগ্রীও রয়েছে। এগুলো একদিকে দেশের মানুষ ব্যবহার করে, অন্যদিকে রপ্তানিও হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন কমায় বাজারে যেমন পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, তেমনি দামও বেড়েছে। একই সঙ্গে রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর-ডিসেম্বরে এবং জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমেছে। তবে তা ডাবল ডিজিটে ছিল। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে ৩ শতাংশে নেমে আসে। সে তুলনায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে কিছুটা বেড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ হয়েছে।

গত অর্থবছর থেকে প্রতি প্রান্তিকে বিদ্যুতের উৎপাদন গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছিল। আগে এর উৎপাদন আরও বেশি বেড়েছিল। তা ছিল ডাবল ডিজিটের উপরে। বিদ্যুতের উৎপাদন কম হওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সূত্র জানায়, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে একদিকে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে হু হু করে বেড়ে যায় দাম। এতে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যয় সাশ্রয় করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের এপ্রিলে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করে। মে মাসে তা আরও বাড়িয়ে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকগুলো ডলারের সংস্থান করতে না পারায় এলসি খোলা সীমিত করে দেয়। একই সঙ্গে ডলারের দাম বেড়ে যায় ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ। এতে শিল্প খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। কাঁচামাল সংকটে বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো এখন বন্ধের পথে। তাদের উৎপাদন কমেছে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। কোনো কোনো খাতে আরও বেশি। মেটাল, রড, ইস্পাত শিল্পের উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। কারণ এসব খাতের কাঁচামাল আমদানি প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে গত বছরের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সারের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ, গ্যাসের দাম দুই দফায় শতভাগের বেশি, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ ও এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম ৪২-৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে সব ধরনের শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। যে কারণে দামও বেড়েছে। এর বিপরীতে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমায় বিক্রিও কমেছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে খাদ্য পণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে উৎপাদন তো বাড়েইনি। উলটো আগের চেয়ে কমেছে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৪ শতাংশ নেতিবাচক। কাঁচামাল সংকট ও সেবার দাম বাড়ানোর কারণে খাদ্য পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে উৎপাদন কমে গেছে। এর আগে গত অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর, জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন এই তিন প্রান্তিকেই উৎপাদন আরও বেশি হারে নেতিবাচক হয়েছিল। এ হার ছিল ১৪ থেকে ২৫ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বস্ত্র জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ২৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে উৎপাদন বাড়েনি। উলটো নেতিবাচক হয়েছে ১ শতাংশ।

মানুষের অত্যাবশ্যকীয় আরও একটি পণ্য হচ্ছে ওষুধ। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে ওষুধ জাতীয় পণ্যের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নেমেছে। এ খাতের কাঁচামাল আমদানি ভয়াবহভাবে কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না। ফলে বাজারে অনেক ওষুধের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দামও বেড়ে গেছে।

একই সময়ের ব্যবধানে পানীয় জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ৫২ শতাংশ বেড়েছিল। চলতি অর্থবছরে বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে চামড়া ও চামড়া জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে উৎপাদন বাড়েনি। উলটো তা কমে ১২ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ২৬ শতাংশ, জানুয়ারি থেকে মার্চে ৩৭ শতাংশ এবং এপ্রিল থেকে জুনে ৪৬ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছিল।

একই সময়ের ব্যবধানে কাঠ ও কাঠ জাতীয় পণ্যের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে তিন ত্রৈমাসিকেই এর উৎপাদন ছিল নেতিবাচক। গড়ে প্রতি ত্রৈমাসিকে ১০ শতাংশ করে উৎপাদন নেতিবাচক ছিল।

পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ১৪ শতাংশ। এখন তা কমে ২ শতাংশ নেতিবাচক। ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কম হওয়ায় উৎপাদনও কমেছে।

গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রাসায়নিক ও এ জাতীয় পণ্যের উৎপাদন নেতিবাচক ছিল ২৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা আরও কমে ২৫ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বেড়েছিল ৩ শতাংশ। বাকি দুই প্রান্তিকে গড়ে কমেছিল ২২ শতাংশ করে।

অধাতু মিনারেল জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ১৪ শতাংশ বেড়েছিল। এখন তা কমে ৬ শতাংশ নেতিবাচক। মৌলিক ধাতু পণ্যের উৎপাদন ২৪ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। ফেব্রিকেটেট মেটাল পণ্যের উৎপাদন ২২ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা ১৬ শতাংশ নেতিবাচক। কোনো প্রান্তিকেই এর উৎপাদন বাড়েনি।

কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক পণ্যের উৎপাদন ১৪ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা আরও কমে ৪১ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে না বলে এর উৎপাদন বেশি কমেছে। এছাড়া মন্দায় এর চাহিদাও কম। যানবাহনের উপকরণের উৎপাদন ১ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা আরও বেড়ে ৫৬ শতাংশ নেতিবাচক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন-দেশে ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ও তীব্র সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় রপ্তানিসহ সব খাতে চাহিদা কমেছে। ফলে উৎপাদনও কমেছে। অনেক শিল্প এখন সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এ অবস্থা বেশিদিন চললে শিল্প গভীর সংকটে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, ইউরোপ-আমেরিকাতে মন্দার কারণে রপ্তানির আদেশ কমে গেছে। ফলে আগামীতে রপ্তানি আয়ও কম হবে। রপ্তানি কমলে উদ্যোক্তাদের তারল্য সংকট বাড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্পে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নিট পোশাকের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ পণ্যের উৎপাদন বেড়েছিল ১৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়েছে। দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি বাড়ার কারণে এর উৎপাদন বেড়েছে। নিট পোশাকের রপ্তানি আয় বাড়লেও ওভেন পোশাকের আয় কমেছে।

আলোচ্য সময়ে তামাক জাতীয় পণ্যের উৎপাদন নেতিবাচক ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৪ শতাংশ হয়েছে।
প্রিন্টিং জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ৩ শতাংশ নেতিবাচক থেকে এখন বেড়ে ৫ শতাংশ ইতিবাচক হয়েছে। পেপার ও পেপার জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। রাবার ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ৭ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা বেড়ে ২ শতাংশ ইতিবাচক হয়েছে। ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রীর উৎপাদন নেতিবাচক ছিল ৩৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১৫ শতাংশ ইতিবাচক হয়েছে। মেশিনারিজ ও এ জাতীয় উপকরণের ১ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা বেড়ে ৯ শতাংশ ইতিবাচক হয়েছে। গাড়ি ও ট্রেইলারের উৎপাদন ১০৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০৬ শতাংশ হয়েছে। ফার্নিচারের উৎপাদন ১৩ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। এখন তা বেড়ে ১১ শতাংশ ইতিবাচক হয়েছে।

শিল্প খাতে উৎপাদন কমার আরও একটি কারণ হচ্ছে নিট হিসাবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছে। টাকার হিসাবে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। শিল্প খাতের জন্য যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয় ডলারে। এ কারণে ডলারের হিসাবকেই এ খাতের জন্য যৌক্তিক বলে ধরা হয়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকার হিসাবে ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নিট হিসাবে আমদানি ও রপ্তানি দুই খাতেই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে সবজির উৎপাদন কম হবে। এর কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ধানের চাষ বেশি হওয়ার কারণে সবজির প্রতি কৃষকের আগ্রহ কমেছে। এ কারণে সবজির আবাদি জমির পরিমাণও চলতি অর্থবছরে কমবে। গত অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ১৭ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ টন। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ লাখ টন কম। এতে কৃষিভিত্তিক শিল্পের উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/660669