২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২০

ডিবি পুলিশের এসির নেতৃত্বে ‘ডাকাতি’

রুহুল আমীন সরকার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি)। তিনি একটি ‘ডাকাত দল’ গঠন করেছেন যাদের সবাই পুলিশের সদস্য। তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি করেন। তাদের মূল টার্গেট জুয়ার আসর। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর কাফরুলের পুলপাড়ে রশিদ কমপ্লেক্সের চতুর্থ চলায় নিউ ওয়েব ক্লাবের জুয়ার আসরে হানা দেয় এসি রুহুল আমীনের নেতৃতে দলটি। সেখানে তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি করে। পালানোর সময় মিলিটারি পুলিশের (এমপি) হাতে আটক হন ১১ জন। পরে তাদের কাফরুল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বুধবার এদের মধ্যে এসি রুহুল আমীন সরকারসহ ১১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, এ ঘটনায় ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার জামিল আহম্মেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় এবং মিরপুর বিভাগের ডিসি মাসুদ আহাম্মদ। তদন্ত কমিটি ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য কৃষ্ণপদ রায় যুগান্তরকে বলেন, তদন্তের মাঝপথে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তদন্ত চলছে। শেষ হলে এ বিষয়ে বলা সম্ভব হবে।
এদিকে মিলিটারি পুলিশের হাতে ডিবির এসিসহ ১১ জন আটক হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপট বিস্তারিত লিখে মিরপুরের ডিসি বরাবর একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে কাফরুল থানা পুলিশ। সেখানে সবার পরিচয় দেয়া হয়েছে ডিবি পুলিশের সদস্য হিসেবে। তারা হলেন- ডিবির এসি রুহুল আমীন সরকার, পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন, এসআই জাহিদুল ইসলাম, এসআই লুৎফর রহমান, এসআই মাহবুবুর রহমান, এসআই তোফাজ্জল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল লতিফ, কনস্টেবল আজিজুল হক, কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম খান ও কনস্টেবল জাহিদুল ইসলাম এবং গাড়িচালক জিল্লুর রহমান।
কাফরুল থানা পুলিশের তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে র্যাব-৪-এর সদস্য পরিচয়ে চারজনকে আটক করে সাদা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছিল এসি রুহুল আমীনের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের একটি দল। খবর পেয়ে কাফরুলের ১৪ নম্বর বিট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কাফরুলের পুলপাড় দিল্লি সুইটসের সামনে গাড়িটিকে চ্যালেঞ্জ করেন। এ সময় একজন র্যাব-৪-এর মেজর মোসাদ্দেক পরিচয় দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। সড়কে যানজট থাকায় গাড়ি সামনে এগুতে পারছিল না। পরে স্থানীয় জনতা তাদের আটক করে মিলিটারি পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।
মিরপুর বিভাগের ডিসি মাসুদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।
নিউ ওয়েব ক্লাবের সভাপতি শফিউল আজম যুগান্তরকে বলেন, সন্ধ্যার পর তারা ক্লাবের ভেতর ঢুকে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে ফেলেন। তাদের সবার কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সেনা বাহিনীর বিভিন্ন পদবী উল্লেখ করে একজন অপরজনকে তারা সম্বোধন করছিল। তারা বোঝানোর চেষ্টা করছিল যৌথ বাহিনীর সদস্য। সবার মানিব্যাগ ও মোবাইল কেড়ে নেয় তারা। পরে ক্লাবের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এর আগে ১৬ মার্চও ওই দলের সদস্যরা ওই ক্লাবে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করেছিল। এ সংক্রান্ত একটি ফুটেজ ১৭ মার্চ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ওই ফুটেজে দেখা গেছে, এ চক্রের সদস্যরাই এর আগে ক্লাবে হানা দিয়েছিল। ফুটেজে তার প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করেছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী নজিবুল্লাহ হীরু যুগান্তরকে বলেন, ডিবি সদস্যরা লোভে পড়ে ডাকাতরা যেভাবে ডাকাতি করে, সেভাবেই কাজটি করেছেন। তবে তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও ভয়ঙ্কর। কারণ ডিবি হয়েও র্যাবের পরিচয়ে কাজটি করেছেন।
এ যেন ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ক্লাবের ভেতর জুয়ার আসর বসেছিল। সেখানে আচমকা ১০-১২ জন ঢুকে পড়ে। তারা অস্ত্র উঁচিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলে। তখন তারা বলতে থাকে, ‘একটু নড়াচড়া করার চেষ্টা করলেই গুলি। কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি চলবে না।’ ক্লাবের সবাই তখন চুপ হয়ে যায়। সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। তারমধ্যে দামি সেটগুলো তারা একটি পলিথিনের ব্যাগে রাখে। সবার কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেয়া হয়। বেরিয়ে যাওয়ার সময় হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে চারজনকে নিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, ওই চার ব্যক্তি হলেন- সুমন আলম, জাহিদ আহম্মেদ, আবদুল আহাদ এবং হাবিব ফরিদ।
ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ক্লাবের এমন একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ফিল্মি স্টাইলে তারা সবাইকে জিম্মি করে সব কেড়ে নেয়। এর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটার কারণে আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম তারা ভুয়া পরিচয় দিচ্ছে। দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তা খোলা হয়। পরে ধাওয়া করে মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় তাদের আটক করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ডিবি সদস্যদের আটকের পর তাদের কাছ থেকে জাল মুদ্রা ও ইয়াবা পাওয়া গেছে। এসব দিয়ে ওই চারজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হতো বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, একমাস আগের ঘটনার পরদিন কাফরুল থানা পুলিশকে সিসিটিভির ফুটেজ দেয়া হয়েছিল। তারা তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি মাসুদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। এছাড়া বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/21/118988/