৩১ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৫৯

দরিয়া মে ঢাল

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

ঢাকার কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক আট লেনের পূর্বাচল সড়কটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওপথে নিজে যাই নাই, বছর খানেক হলো। ফলে সড়কটি কতটা দৃষ্টিনন্দন ও কতটা অত্যাধুনিক সে বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। সর্বশেষ যখন গিয়েছি তখন সে পথে নরককাণ্ড চলছিল। খানা-খন্দ অবর্ণনীয় জ্যাম ছিল সে সড়কজুড়ে। আর মাঝে মাঝে ট্রাফিক বিভাগ যাত্রীদের এই বলে সতর্ক করতো যে এই পথে চলাচল সীমিত রাখুন তবে এই ‘দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক’ সড়কটির কাজ সম্পন্ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সড়কটির উদ্বোধন করার কথা আগামী ডিসেম্বরে। সেজন্য বাকী কাজগুলো জোরেশোরে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

কিন্তু পত্রিকায় রিপোর্ট থেকে জানা যায়, উদ্বোধনীর পরপরই সড়কটি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কারণ ঐ সড়কের ঠিক মাঝখান দিয়ে বসবে খুঁটি বা স্প্যান। ২০২৪ জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে পারে মেট্রোলের খুঁটি স্থাপনের কাজ। সড়কটিতে পড়েছে অনেক সেতু, আন্ডারপাস ও গ্রেড ইন্টারসেকশন। সেগুলোও ভেঙ্গে ফেলতে হবে।

এর মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি পাতাল রেলের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছেন শেখ হাসিনা। এটাই দেশের প্রথম পাতাল রেল। এই রেল পথের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত থাকবে মাটির নিচ দিয়ে। আর রূপগঞ্জের শীতলগঞ্জ থেকে জোয়ারসাহারা নতুন বাজার পর্যন্ত রেল পথটি হবে পূর্বাচল নিতশ’ ফুট সড়কের বিভাজন বরাবর উপর দিয়ে। এটি হবে উড়াল পথ।

সড়কটির নির্মাণে রাজউকের ব্যয় ধরা আছে এক হাজার দুইশত পঞ্চাশ কোটি টাকা। কাজ শেষে সে ব্যয় বেড়ে দেড় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে। সড়কটিতে রয়েছে বারোটি সেতু, ছয়টি আ-ারপাস, পাঁচটি গ্রেডইন্টার শেকসন ও ছয়টি ফুট ওভারব্রিজ। যে ছয়টি আন্ডার পাস আনা হবে তার প্রতিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে নব্বই থেকে একশ কোটি টাকা। প্রতিটি আন্ডারপাসের নিচে তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের জলাধার ও দুইটি পাম্পিং স্টেশন। যার মাঝ বরাবর মেট্রোরেলের খুঁটিগুলো বসালে এগুলো তো ভাঙা পড়বেই, সঙ্গে রাস্তাটিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাস্তাটিকে পুনরায় ‘দৃষ্টিনন্দন’ ও অত্যাধুনিক করতে ফের কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আর এটি হবে রাজউকের ভুল পরিকল্পনার খেসারত।

পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত বারো কিলোমিটার সড়ক তৈরির প্রস্তাব ২০১৩ সালে একনেকে পাস হয়। পরে অর্থ সংকটের কারণে তিনশত কোটি টাকা ব্যয়ে চারলেনের রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তিনশত কোটি টাকার স্থলে সাতশত সাতচল্লিশ কোটি টাকা ব্যয়ে ঐ সড়কটির কাজ শেষ হয়। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পরই পরিকল্পনায় পারিবর্তন এনে রাস্তাটি সম্প্রসারণ, সার্ভিস রোড ও দুই পাশে একশত ফুট করে প্রশস্ত খাল খননসহ আরো অনেক কিছু সংযুক্ত করে নেয়া হয়। তিনশত ফুট সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প আসার প্রকল্পে মোট পাঁচ হাজার দুইশত ছিয়াশি কোটি টাকা ব্যয়ের পর নতুন সম্প্রসারিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় দশ হাজার তিনশত ঊনত্রিশ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সড়কের মাঝে চার মিটার প্রশস্ত বিভাজন রাস্তা হয়েছে মেট্রোরেলের খুঁটি বসানোর জন্য। এক একটি খুঁটি বসাতে যে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়, তা চার মিটার জায়গার মধে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। যন্ত্রগুলো ব্যবহারের জন্য অন্তত তিন হাজার ছয়শত বর্গাকার জায়গা প্রয়োজন। তাতে খুঁটি বসানোর সময় ষাট ফুট রাস্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ব্রিজ আন্ডারপাস ও ইন্টার শেকশনের সবগুলো স্থাপনাই কংক্রিটের তৈরি। এ রকম জায়গায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কীভাবে খুঁটি বসাবে, তা কারো কাছে বোধগম্য নয়। পূর্বাচলে প্রথম তৈরি তিনশ ফুট সড়ক প্রকল্পের পরামর্শক ছিলেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, পূর্বাচল সড়কে থাকা গ্রেড ইন্টার শেকশনগুলোর দৈর্ঘ্য চার-পাঁচশ মিটার। অথচ মেট্রোরেলের একটি স্প্যান থেকে আর একটি স্প্যানের দূরত্ব হতে পারে একশত পঞ্চাশ মিটার। কাজেই গ্রেড ইন্টার সেকশনগুলো ভাঙা পড়বেই। আর আন্ডার পাসগুলোকে অক্ষত রেখে কীভাবে সেখানে স্প্যান বসবে প্রকৌশলী হিসাবে তার কাছে সেটি বোধগম্য নয়। মেট্রোরেলের কাজ শেষে আবারও এসব নতুন করে তৈরি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, প্রথম তৈরি করা চার লেনের রাস্তাটির স্থায়িত্ব ধরা হয়েছিল বিশ থেকে পঁচিশ বছর। এই রাস্তাটিই চলতে পারতো। উচিত ছিলো মেট্রোরেল তৈরির পর পরবর্তী সম্প্রসারিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

পূর্বাচল রাস্তার প্রকল্প পরিচালক এহসান জামিল বলেন, ‘এই সমস্যাগুলো নিয়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। আমরা সেখানে বলেছি, পূর্বাচল থেকে জোয়ার সাহারা অংশও মাটির নিচ দিয়ে নেয়া যায় কিনা। তারা বলেছে সব কিছুই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন আর নকশা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আমার তো মনে হয় না, পাঁচ শত পঞ্চাশ মিটার দীর্ঘ দূরত্বে মেট্রোরেলের স্প্যান বসানো সম্ভব। তা না হলে রাস্তার তো ক্ষতি হবেই। পাশের জমিরও ক্ষতি হবে।’

এমআরটি লাইন এক এর প্রকল্প পরিচালক আবুল কাসেম বলেন, ‘বালু নদীর ব্রীজে সমস্যা হতে পারে সে জন্য সেখানে একশত সত্তর মিটার দূরত্বে স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা আছে। আর কোথায়ও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাড়ে পাঁচশত মিটার আন্ডারপাস থাকলে তাদের কনসালটেন্ট এভাবে করলো কেন? আমাদের তো এখন আর মেট্রোর নকশায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ভূগর্ভে রেললাইন তৈরির খরচ অনেক বেশি। সরকার এসব দেখেই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।’ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পাতাল রেলের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করার পর শীতলগঞ্জ ডিপো এলাকার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আগামী বছরের প্রথম ভাগেই হয়তো স্প্যানগুলো বসানোর কাজ শুরু হতে পারে।

রাজউকের পূর্বাচল পরিচালক মনিরুল হক বলেন, সাবেক পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও মেট্রোরেলটি মাটির নিচ দিয়ে নেয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। আর সম্প্রসারিত সড়ক প্রকল্পের কনসালটেন্ট ছিলো ডাটা এক্সপার্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তার প্রশ্ন, তারা কেন এমন সমন্বয়হীন ডিজাইন করলো। ডাটা এক্সপার্টের পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের ডিজাইন হয়ে গেছে। এম.আর.টি কর্তৃপক্ষ এটা মাথায় রেখে ডিজাইন করলে সমস্যা হবে না। আর আমরা যখন ডিজাইন করেছি তখন তো এম.আর.টির ডিজাইন হয়নি। তাদের তো সব কিছু আমলে নিয়েই ডিজাইন করার কথা। বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, পূর্বাচল সড়কে স্প্যানগুলো বসাতে গেলে সড়কের মধ্যে থাকা সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আধা কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে আন্ডারপাসগুলো এড়িয়ে কোনোভাবেই স্প্যান বসানো সম্ভব নয়। এখানে সমন্বয় ও জবাবদিহিতা না থাকায় এসব হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন যে এটার অনুমোদন দিল তারা এটি বুঝল না। কারণ সেখানে পরিকল্পনাবিদ নেই। যে কারণে কিছুদিন পরপর দেখা যায় একটি প্রকল্পের সঙ্গে আরেকটি প্রকল্পের সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। অপচয় হয় বিপুল অর্থের। সড়ক যদি ভাঙতেই হয় তা হলে সড়ক নির্মাণ শেষ করার জন্য এতো তাড়াহুড়া কেন? দেখা যাচ্ছে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করার জন্য। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের এক কথা আমাদের তো ডিজাইন করা হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়। তবে কি দেশের মানুষের হাজার হাজার কোটি ট্যাক্সের পয়সা অপচয় করা খুবই সম্ভব? এর কোনো দায় নেই, দায়িত্ব নেই, সমন্বয় নেই। সরকার কা মাল, দরিয়া মে ঢাল।

https://dailysangram.com/post/520762