২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৮:১৯

বিদ্যুতে ভোগান্তি : বিব্রত সরকার

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত না হলেও দফায় দফায় দাম বাড়ছে : ভোগান্তিতে বিভিন্ন জেলার গ্রাহকরা অতিষ্ঠ উৎপাদন বাড়ানোর পরও বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তি দূর হয়নি। রাজধানীর তুলনায় জেলা শহরগুলোতে বিদ্যুতের দুরবস্থা অনেক বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, উৎপাদন ঠিকই আছে; চাহিদাও উৎপাদনের চেয়ে খুব বেশি নয়। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কেন এই লোডশেডিং? এর কোন জবাব বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা দিচ্ছে না। তবে ভোগান্তি নিয়ে গ্রাহকদের মন্তব্য হচ্ছে- নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলেও সরকার বিদ্যুতের দাম ঠিকই বাড়াচ্ছে দফায় দফায়।
এদিকে বিদ্যুতের এই দুরবস্থায় ২০২১ সালের মধ্যে সরকার প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার যে রূপকল্প ঘোষণা করেছে তার বাস্তবায়নও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রæটি রেখে বিদ্যুতের নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা সরকারকে আরও সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
পিডিবি’র তথ্যানুযায়ী, গত সাত বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা চার গুণের বেশি বেড়েছে। কিন্তু এই পরিমাণ উৎপাদন বাড়িয়েও ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী বিতরণ কোম্পানীগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। এতে করে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। রাজধানীর তুলনায় এই লোডশেডিংয়ের তীব্রতা জেলা শহরগুলোতে অনেক বেশি। এমন অনেক জেলা রয়েছে- যেখানকার গ্রাহকরা বিদ্যুতের ভোগান্তিতে একেবারেই অতিষ্ঠ।
পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ¥ীপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নিলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ দেশের প্রতিটি এলাকাতেই চলছে লোডশেডিং।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছি। বিদ্যুতের নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চল নীতি অনুসরণের কোন নির্দেশনা আমরা পাইনি। বরং আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যেই আরইবি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে যাতে ভোগান্তি না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। আর লোডশেডিং প্রশ্নে তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে কোন এলাকায় বিতরণ লাইনে ত্রæটির কারণে বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তি দেখা দিতে পারে। তবে সার্বিকভাবে আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি এবং তা গ্রাহককে সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি জানান, বর্তমানে আরইবি’র ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেয়ার ক্যাপাসিটি রয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার আমাদের গ্রাহক চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৭শ’ মেগাওয়াট। আমরা এই পরিমাণ বিদ্যুতই বিতরণ করেছি। কোন ঘাটতি ছিলনা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ১৪ হাজার মেগাওয়াটের উপরে। তবে উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজার মেগাওয়াটের কিছু উপরে। গত মঙ্গলবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড ছিল ৯ হাজার ২১২ মেগাওয়াট। উৎপাদনের সাথে চাহিদার কোন ঘাটতি ছিলনা। তাহলে কেন এই লোডশেডিং জানতে চাইলে পিডিবি’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ত্রæটিপূর্ণ বিতরণ ব্যবস্থার কারণে এমনটি হতে পারে।
তবে পিডিবি’র অপর এক কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদন ও বিতরণের মাঝে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। হিসাবের এই ফাঁকিটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত হিসাবটা জানা যাবে না। এই কর্মকর্তার মতে, লোডশেডিং আরও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব-যদি সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তিনি বলেন,পিডিবি’কে চাহিদা মোতাবেক গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। যদি আর ৩শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো তাহলে অতিরিক্ত আরও ১৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন করা সম্ভব হতো।
পিডিবি সূত্র জানায়, গ্যাস সংকটের কারণে অনেকগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। আবার অনেকগুলো থেকে ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সুযোগ থাকলেও দৈনিক প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ অবস্থায় পিডিবির হাতে বিকল্প রয়েছে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কিন্তু এগুলোতে যত বেশি উৎপাদন তত বেশি খরচ। তাই বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য সহনশীল রাখতে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া অন্য উপায় দেখছেন না নীতি-নির্ধারকরা। এ অবস্থায় চলতি এপ্রিলেই সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাত থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশাল ও পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘোড়াশাল সার কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৪২২ টন এবং পলাশ সার কারখানার ৩০০ টন।
পিডিবি’র তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৭০ থেকে ৮০টিতে। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার এক তৃতীয়াংশের বেশিই অব্যবহৃত থাকছে। গতকাল (বুধবার) গ্যাস সংকটের কারণে ১৪টি গ্যাসচালিত কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। এগুলো হলো সিদ্ধিরগঞ্জ, টঙ্গী, শিকলবাহা, হরিপুর, চট্টগ্রাম ১-২, আশুগঞ্জ প্রিসিশন, আশুগঞ্জ মডিউলার, চাঁদপুর, কুমিল্লা আরপিসিএল, সিলেট ১৫০, সিলেট ২০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই। গ্যাস সংকটে কিছু কেন্দ্র বন্ধ বা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হলেও অন্য জ্বালানি থেকে চাহিদামত উৎপাদিত হচ্ছে। সরবরাহে যেটুকু ঘাটতি রয়েছে, তা মূলত সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারণে। এ সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিদ্যুতের লোডশেডিংকে কেন্দ্র করে জনদুর্ভোগ যখন চরমে, তখন বিতরণ কোম্পানিগুলো আরও একদফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা পেশ করেছে বিইআরসি’র কাছে। বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ডিপিডিসি, ডেসকোসহ সকল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানীর পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/75964/