৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:৫৭

রাজধানীর বেসরকারি স্কুলে ‘গলাকাটা’ ফি আরোপ

সরকারকে ফাঁকি দিতে বছরের শুরুতে কম নেওয়া হয়

চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে ভর্তিকালে ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়।

আইন ও পরামর্শ, নির্বাচন খরচ, গ্র্যাচুইটি, ওয়াসা-পৌরকর ও গ্যাস, পুরস্কার বিতরণী, ডায়েরি-সিলেবাস-ক্যালেন্ডারসহ ২৪ খাতে এ অর্থ নেওয়া হয়।

কিন্তু একই ধরনের কয়েকটি খাতে এখন আবারও অর্থ জমা দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের কাছে এসএমএস পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টিউশন ফি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠানটি নয়, রাজধানীর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সরকারি তদারকি কমিটির তৎপরতার কারণে বছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত হারের বাইরে অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারেনি। তাই দুই মাস না যেতেই এখন ফাঁদ পেতে বসেছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্কুলে সন্তানের বিভিন্ন ফি বিশেষ করে একই খাতে দ্বিতীয়বার ফি আদায়ের পদক্ষেপে অভিভাবকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা স্কুলগুলোর এই পদক্ষেপকে ‘অনৈতিক এবং ভাঁওতাবাজি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো স্কুলই সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত আদায় করতে পারবে না। এ নিয়ে সারা দেশের জন্যই মাউশির তদারকি দল আছে। ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তারা এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ পাননি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখায় ইংরেজি ভার্সনে বছরের শুরুতে ডায়েরি, সিলেবাস ও ক্যালেন্ডার এবং ওয়াসা খাতে ৬শ টাকা নেওয়া হয়। এখন আবার একই খাতে ৯৫০ টাকা দাবি করা হয়েছে। ২৩টি খাত উল্লেখ করে তখন টাকা আদায়ের পর আর কিছু খুঁজে না পেয়ে ‘বিবিধ’ খাত সৃষ্টি করে ছাত্র প্রতি ২১৫ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু এখন আবার ম্যাগাজিন, দরিদ্র তহবিল, রিপোর্ট কার্ড, বিদায় অনুষ্ঠান এবং জাতীয় উৎসব নামের খাতে ১ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। অভিভাবকদের আপত্তি হচ্ছে, রিপোর্ট কার্ডের জন্য ৩শ টাকা কী করে আদায় করতে পারে। আবার স্কুলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে মামলার মুখোমুখি হয়। সেই মামলার খরচও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। এই খাতে ধার্য করা হয়েছে ৮০ টাকা করে। ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এখানে আদায় হয় ২৪ লাখ টাকা।

স্কুলে তিন বছর পরপর পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে, যার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬ লাখ টাকা। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি জানুয়ারি থেকে বাড়ানোর বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন।
একজন অভিভাবক যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি টিউশন ফি ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এ খাতে বাড়তি আদায় হবে ৩০ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন খাতে আদায়ের ক্ষেত্রে শুধু প্রথমবার ভর্তির সময় টাকা নেওয়ার রসিদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে রকেটের মাধ্যমে নেওয়া হয়, যার কোনো ডকুমেন্ট দেয় না।

এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করেও প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বনশ্রী শাখার বাংলা ভার্সনের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন যুগান্তরকে বলেন-মামলা, নির্বাচন কিংবা ওয়াসাসহ অন্যান্য সেবার খরচ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়ের কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই। কেননা, প্রতিষ্ঠানের এসব খাতে খরচ আছে। আর বছরের শুরুতে যেসব খাতে অর্থ আদায় করা হয়েছে, তাতে এখন অর্থ নেওয়ার কথা নয়। স্কুলে গিয়ে নোটিশ না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।

একই ধরনের অভিযোগ এসেছে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। বছরের শুরুতে একবার বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যথাক্রমে ৮ ও ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। কোন খাতে কত নিয়েছে তা জানায়নি। এখন প্রথমে মার্চে স্মরণিকার জন্য শিক্ষার্থী প্রতি ৩শ টাকা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এক মাস না যেতেই টিউশন ও পরীক্ষার ফি বাদে আরও ১৯টি খাতে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ খাতে অভিভাবকদের এখন দিতে হবে ২৮৭০ টাকা। দুই মাসের মধ্যে টাকা না দিলে ভর্তি বাতিল করা হবে বলে স্কুলের ফির রসিদে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর পুনঃভর্তি হলে আরও দেড় হাজার টাকা দিতে হবে।

একজন অভিভাবক জানান, প্রতিবন্ধী ফি নামে সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ১৮০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থী আছে। সাড়ে ১৩ লাখ টাকা আদায় হচ্ছে। আবার প্রতিমাসে মেনটেন্যান্স ও এসএমএস ফি বাবত ১৩০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। বিপরীত দিকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে। প্রথম শ্রেণিতে একজন শিক্ষককে দিয়ে তিনটি ক্লাস নেওয়ানো হয়। ফলে ওই শিক্ষকের পক্ষে মানসম্মত পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এএনএম শামসুল আলম খান যুগান্তরকে বলেন, ভর্তির সময়ে সরকারি নির্দেশনামতো টাকা নিতে হয়েছে। তখন যেসব খাতে অর্থ নেওয়া যায়নি, এখন তা নেওয়া হচ্ছে। ভিকারুননিসা, আইডিয়ালসহ অন্যান্য স্কুলের যেভাবে নেওয়া হচ্ছে তারাও সেভাবেই নিচ্ছেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত বসে আছে। তারা নিজেদের অবৈধ আয়ের উৎস হিসাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেছে নিয়েছে। সরকার বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তরিক না হলে অভিভাবকদের গলা রক্ষা পাবে না।

এ প্রসঙ্গে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত গণ্ডগোল হচ্ছে তার মূলে আছে এই অর্থ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে তা তছরুপের অভিযোগ পর্যন্ত আছে। তাই যাতে ইচ্ছামতো ফি আদায় করতে না পারে এবং আদায়কৃত অর্থ কোথায় যায় ও কীভাবে ব্যয় হচ্ছে-সেই তথ্য সরকারের জানা জরুরি। কেননা, সরকার প্রতিষ্ঠানে শতভাগ বেতন দিচ্ছে। বিভিন্ন ভাতা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দিচ্ছে। তাই সরকারি স্কুলের ফি যদি সরকারের জানার মধ্যে থাকে, তাহলে বেসরকারি স্কুলের ফি সম্পর্কেও ধারণা থাকা জরুরি। এজন্যই ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় ও ব্যয় সংক্রান্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এর খসড়া করে আমরা জমা দিয়েছি। শিগগিরই সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কর্মশালার মাধ্যমে তা চূড়ান্ত করা হবে।

প্রস্তাবিত নীতিমালায় যা আছে : জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন, ভর্তি ফি, সেশন ফি এবং বোর্ড পরীক্ষার ফরমপূরণ ফিসহ যাবতীয় আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় এক বছর আগে মাউশি থেকে নীতিমালার খসড়া করে পাঠানো হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয়ে সেটি ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। ইতঃপূর্বে চিন্তা অনুযায়ী, এ নীতিমালা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি ও বেতনের অর্থ আদায় করতে হবে। কোনোভাবে তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করা যাবে না। আদায়কৃত সব অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে জমা রাখতে হবে।

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত নীতিমালায়, এমপিওভুক্ত সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ আদায়ের খাত তৈরি করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ও তার আশপাশ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির মাসিক বেতন ২৫ থেকে ৪৫ টাকা, জেলা সদর ও পৌর এলাকায় ২০ থেকে ৪০ টাকা, উপজেলায় ১৫ থেকে ৩৫ এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ১২ থেকে ৩০ টাকা নির্ধারিত থাকবে। ভর্তির আবেদন ফি পর্যায়ক্রমে ৭৫ থেকে ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হবে। ভর্তি ও পুনঃভর্তি ফি ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা ধার্য থাকবে। এছাড়া ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার ফি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা নেওয়া যাবে। এছাড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাবদ ৫০ টাকা, ম্যাগাজিন ফি ১০০, মুদ্রণ বাবদ ১৫০, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক ও বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনে ৫০ থেকে ৭৫ টাকা, কম্পিউটার চার্জ ২৫ থেকে ৫০ টাকা, কৃষি ও বাগান ফি (যদি থাকে) ৩০ টাকা, কমন রুম ফি ২০ থেকে ৩৫, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ফি ৫, বিএনসিসি ফি ৫, রেডক্রিসেন্ট ফি ২০, মসজিদ ও উপাসনালয়ের জন্য ২৫ থেকে ৫০ টাকা ধার্য করা থাকবে। স্কাউট ফি, ক্রীড়া, কল্যাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফিও বোর্ড থেকে নির্ধারণ করে দেবে। উন্নয়ন ফি ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী আদায় করা যাবে।

কলেজ পর্যায়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৮০ থেকে ১৫০ টাকা, অনলাইন আবেদন, রেজিস্ট্রেশন ফি, উন্নয়ন ফি ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারণ করা থাকবে। প্রতি বিষয়ে অভ্যন্তরীণ ফি ৫০ থেকে ৪০ টাকা আদায় করা হবে। কলেজে সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব আছে। এছাড়া কল্যাণ ফি বাবদ ২০ টাকা, পরিচয়পত্র ফি ৩০ টাকা, লাইব্রেরি ফি ২৫ টাকা, ল্যাবরেটরি/বিজ্ঞানাগার ফি ১০০ টাকা, আইসিটি ফি ২০ টাকা, ম্যাগাজিন খাতে ৩০ টাকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যয় ৩০ টাকা, সাংস্কৃতিক, বিতর্ক ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নির্ধারণ করা থাকবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/659946