৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:৫৬

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু থামেনি

নাছির উদ্দিন শোয়েব: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু কিছু দিন থেমে ছিল। বিশেষ করে টেকনাফে পুলিশের গুলীতে মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের নিহত হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধ ও হেফাজতে মৃত্যু অনেকটাই কমে যায়। এরপর র‌্যাব এবং এর সাতজন কর্মকর্তার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতরের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তি যারা, তাদের ভাষায়, মানবাধিকার লংঘন ও নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞারই অন্তর্ভূক্ত ছিল বাংলাদেশের র‌্যাব ও এর ছয় জন কর্মকর্তা।

সম্প্রতি নওগাঁ সদরের ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে তার মৃত্যুর বিষয়টি ব্যাবপক আলোচিত হয়। এ ঘটনার জেরে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে আবার সরব হয়ে উঠেন মানবাধিকার কর্মীরা। র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি তৈরি করা বলে দাবি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেছেন, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পর চাপে পড়ে ক্রসফায়ার কমেছে। মেজর সিনহা হত্যার পরও ক্রসফায়ার কমেছিল। দেশি-বিদেশি চাপে এটি কমলেও হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে। একটি কমলে আরেকটি বাড়ে। মৌলিক অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, এসব কা-ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। তাই অপরাধীদের মজ্জাগত ধারণা এসেছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূতভাবে এবং তাদের হেফাজতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের হাতে ১৩ এবং র‌্যাবের হাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। র‌্যাবের ক্রসফায়ারে ৪ জন নিহত হয়েছে। সংস্থাটির হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। পুলিশের হেফাজতে ৭ জনের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে বলে আসক বলছে। দুজন আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন। তাদের মধ্যে দ-প্রাপ্ত আসামি ২৮, বিচারাধীন ৩৭ জন। নূর খান বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। কারাগারে মৃত্যুর একটি অংশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। এটাও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের কারণেই হচ্ছে।

তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের গুলীতে মেজর সিনহা মো. রাশেদের হত্যার পর প্রায় পাঁচ মাস দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ ছিল। এ ঘটনার পর ওই বছর বন্দুকযুদ্ধের একটিমাত্র ঘটনা ঘটে ২ আগস্ট সিলেটে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, মেজর সিনহা নিহত হওয়ার আগে ওই বছরেরই প্রথম সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ার বন্ধ ছিল। এরপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ফলে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার ইচ্ছা করলে ক্রসফায়ার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু তথা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করতে পারে এবং চালুও রাখতে পারে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা- ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে স্বাধীন একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

গত মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নওগাঁর (সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু) ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি কাজ করছে। যেহেতু একটি অভিযোগ এসেছে যে, আমাদের হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান সেহেতু আমরা সোমবার একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এখানে আমাদের সদস্যদের গাফিলতি রয়েছে কি না বা অনৈতিক কিছু ঘটেছে কি না, আমরা সেটা তদন্ত করছি। গাফিলতি পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদালতও আমাদের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন। সেগুলো আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতকে জানাব।

জেসমিনের মামলাটি তৈরি করা, আসক: নওগাঁয় র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি তৈরি করা বলে দাবি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর লালমাটিয়ায় আসকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নুর খান এ দাবি করেন। নুর খান বলেন, নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাব যে মামলা দিয়েছে সেই মামলার এজাহার দেখলে বোঝা যাচ্ছে ঘটনাটি সৃজনকৃত বা তৈরি করা। এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি। পুলিশের কোনো কার্যক্রম র‌্যাবের ওপর বর্তায় না জানিয়ে নুর খান বলেন, জেসমিন ইস্যুতে এখন সরকারের উচিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের মধ্যদিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা। জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকতকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাজশাহী র‌্যাব ক্যাম্পে কেন নেওয়া হয়েছিল এবং কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সৈকতকে কী ধরনের বার্তা দিয়েছেন তা খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া শাহেদসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিরাপত্তাসহ তাদের সঙ্গে র‌্যাব যেন কোনোভাবে যোগাযোগ না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জেসমিনের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, জেসমিন আটকের সময় তার হাতে সোনার চুড়ি, গলায় সোনার চেইন, কানে দুল ছিল যা জব্দ তালিকায় নেই। এমনকি র‌্যাব বা কোনো পক্ষ থেকে এগুলো পরিবারকে ফেরতও দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, স্থানীয় থানা থেকে আমরা জেনেছি জেসমিনকে আটকের বিষয়টি থানা অবহিত ছিল না। এমনকি আটকের পরও না। পুলিশের কাছে কোনো মামলাই হয়নি। জেসমিনের তো একটা ঠিকানা ছিল, এভাবে আটকের এখতিয়ার র‌্যাবের নেই।

এ ইস্যুতে আসকের অনুসন্ধানে কী পাওয়া গেছে এ বিষয়ে নুর খান বলেন, আমাদের অনুসন্ধান চলছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি বিতর্কিত আইন বলে আপনারা বলে আসছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় আগে আসামি গ্রেফতার করে, এরপর মামলা দেয়। আবার আইনমন্ত্রী বলেছেন, তাদের একটি সেল আছে। মামলা হলে সেই সেল আগে সবকিছু নিরূপণ করে। জেসমিনের ক্ষেত্রে কী তার ব্যত্যয় ঘটেছে- এমন প্রশ্নে নুর খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানুষকে যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, এজন্য আমরা মামলাটি বাতিল চেয়েছিলাম। জেসমিনের ঘটনায় যা ঘটেছে তা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীত ঘটনা ঘটেছে।

https://dailysangram.com/post/520705