৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২:৪৫

সংকটের কবলে শিক্ষা ব্যবস্থা: সাধারণ শিক্ষা

-ড. মো. নূরুল আমিন


॥ গতকালের পর ॥
মানুষের সংজ্ঞা, সৃষ্টি বা বিবর্তন নিয়ে যে তিনটি ধারণা বর্তমান দুনিয়ায় বিদ্যমান আছে তার দু’টি হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন থিউরী ও বার্নার্ড শ’র সংজ্ঞা, এগুলো এসেছে বিশ্ব ব্রহ্মা- ও দুনিয়াতে মানুষের ও পশু পাখির আগমনের হাজার হাজার বছর পরে। আগেই বলেছি এগুলো ইতিহাস নির্ভর নয়, ফসিল বা জীবশ্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভর, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খৃস্টান কোন ধর্মের লোকেই এই তত্ব বা সংজ্ঞা বিশ্বাস করেন না। বিশ্ব ব্রহ্মা- তথা মানুষ, জীব জন্তু, সাগর-নদী বা অন্য জন বা জন সম্পদ সৃষ্টির ইতিহাস একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন এবং তা তার প্রেরীত আসমানী কিতাবসমূহ তার ফেরেস্তাদের দিয়ে নবীদের মাধ্যমে আমাদের অবহিত করেছেন। সর্বশেষ আসমানী কিতাব তথা আল কুরআনে এ ধরনের ভুরি ভুরি তথ্য পাওয়া যায়। তার কয়েকটি সূরা আল বাকারায় বিধৃত হয়েছে। এর ১০৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তুমি কি জান না মহাকাশ এবং পৃথিবীর রাজত্ব কর্তৃত্ব শুধুমাত্র আল্লাহর এবং তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ওলিও নেই, সাহায্যকারীও নেই। একই সুরার ২১ নং আয়াতে তিনি ইরশাদ করেছেন “হে মানব সমাজ তোমরা এবাদত করো তোমাদের রবের যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরও এভাবে তোমরা রক্ষা পেতে পারো।

এই সূরার ৩০ নং আয়াতে তিনি বলেছেন স্মরণ করো, তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করতে যাচ্ছি। তারা বলেছিল আপনি কি সেখানে এমন কাউকে নিয়োগ করবেন যারা সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তাদের এ কথার জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। জ¦ীন ও মানুষকে আল্লাহ তার ইবাদত করার জন্য যে সৃষ্টি করেছেন তা আগেই ঘোষণা করেছেন “ওমা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লালেইয়া বদুন”

ইহুদী খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ কর্তৃক মানুষ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, হিন্দু এবং বৌদ্ধরা ও তা স্বীকার করেন। শ্রীলংকার Adam peak যারা জেয়ারত করেছেন তারা জানেন যে সারা দুনিয়ার কোটি কোটি লোক তাদের পূর্ব পুরুষ হজরত আদম (আঃ) এর স্মৃতি প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রতিদিন এই পাহাড়টি পরিদর্শনের জন্য এখানে আসেন। এদের কেউই নিজেদের বানরের বংশ বলে মনে করেন না।

শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, সিলেবাস তৈরি, পাঠ্যবইসহ শিক্ষা উপকরণ তৈরি প্রভৃতি হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ কমিটির কাজ, এদের যাচাই বাছাই খুব সহজ নয়, শিক্ষা কমিশন আমাদের দেশে অনেক হয়েছে। কিন্তু তাতে জনগণের চাহিদা ও আত্মার প্রতিধ্বনী না থাকায় কোনটিই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শিক্ষক হলেই বা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ক্লাশ নিলেই শিক্ষাবিদ হওয়া যায় না, ১৯৬২ সালে তৎকালীন প্রধান সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গঠিত শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে আমি একজন তরুণ সৈনিক ছিলাম, ফরিদাবাদ সংলগ্ন আইজি গেটের অদূরে করিমুল্লাহর বাগ নামক একটি স্থান আছে, সেখানে আমরা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের উপর একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম; প্রধান অতিথি ছিলেন ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি এই কমিশন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আইয়ুব খানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আইয়ুব খান তুমি শিক্ষা কমিশন করেছ ভাল কথা, তাতে সদস্য করার লোক পাওনি, আমি তোমার চোখে পড়িনি, পড়েছে আমার ছেলে শফিউল্লাহ, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ক্লাশ নিয়েছে মাত্র, শিক্ষাবিদ হতে পারেনি। শিক্ষাবিদ ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

শিক্ষার চাহিদা নিরূপণের সাথে দেশের দক্ষ জনশক্তি, সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক তৈরির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। এজন্য প্রথম যে জিনিসটি জড়িত সেটি হচ্ছে জাতীয় আদর্শ, জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়, বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ সর্ম্পকে সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের সকল নাগরিকদের আছে কিনা এ ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান। এটি হচ্ছে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য সূত্র, চিন্তাধারা ভাবধারা প্রভৃতি যা জাতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ তৈরি করে; তবে এটা অবশ্যই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার কোন বিষয় নয়, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা কি বাঙ্গালী না বাংলাদেশী তা এখনো অমীমাংসিত।

তবে দু’টি বিষয় আমাদের জাতীয় আদর্শ নিয়ে আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারে, এর একটি হচ্ছে আমাদের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, ইমান আকিদাগত পরিচিতি, শতকরা ৯২ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে এটা অস্পষ্ট নয় বাস্তব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের প্রজাতন্ত্র অংশের ২ক ধারার বিধৃত রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। তবে এতে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কর্তৃক সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

সংবিধানের এই ধারা এবং জনসংখ্যা বাস্তবতা থেকে এটা পরিষ্কার যে ইসলাম, আমাদের জাতীয় আদর্শ। আমাদের আচার আচরণ, নীতি নৈতিকতা চলন বলন ও সংস্কৃতির উৎস হচ্ছে ইসলাম।

এ প্রেক্ষিতে আমাদের শিক্ষা চাহিদা নিরূপণের উপাদান হিসাবে জাতীয় আদর্শ জাতীয় মূলনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, দেশে ও বিদেশে জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ বিস্তৃতি ও পরিবর্তন, দক্ষতা ও কর্মকুশলতা, জাতি গঠনের জন্য উপযোগী প্রযুক্তি, ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদা প্রভৃতিকে সামনে রেখে আমাদের জাতীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়নের জন্য এগিয়ে যাওয়া দরকার। যে কারণেই হোক আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বিধাবিভক্ত একটি আখেরাত বিমুখ আরেকটি আখেরাতমুখী। জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে দু’টি ব্যবস্থার মধ্যেই সামঞ্জস্য আনা অপরিহার্য। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে আমাদের নৈতিক শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে, ধর্ষণ ব্যভিচার মাদকাশক্তি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। টেক্সট বুক বোর্ড প্রণীত বইতে ইসলাম বিদ্বেষ, যৌনাচার প্রভৃতিকে উৎসাহিত করা ছাড়াও মানুষকে পশুর বংশধর বানিয়ে তাদের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এটা রোধ করতে না পারলে জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে না। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। মুসলমান ছেলে মেয়েদের আকিদা বিশ্বাস নষ্ট করার জন্য হিন্দু পুরান ও দেব দেবীদের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করে বইপত্রের ইসলামী বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। মাদরাসা এবং মাদরাসায় শিক্ষা ব্যবস্থার বেলায় ও একই কথা প্রযোজ্য। এই অবস্থায় জেনারেল শিক্ষা এবং মাদরাসা শিক্ষা উভয় ক্ষেত্র থেকে অভিজ্ঞ ও পা-িত্য সম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শিক্ষা কমিশন করে শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, পাঠ্যসূচী তৈরি শিক্ষা সামগ্রী উৎপাদন এবং তা যথাযথ পরিধারণ ও মূল্যায়নের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যে পাঠ্যপুস্তক তৈরি ও বিতরণ করা হয়েছে তা বাজার থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেয়া অপরিহার্য্য। কুশিক্ষা থেকে অশিক্ষাই ভাল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে আদর্শবান মুসলিম কর্মকর্তা কর্মচারী ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়োগ দেয়া বাঞ্ছনীয়, জনসংখ্যার সাথে সংগতি রেখে ইসলাম বহির্ভূত ধর্মের প্রয়োজনে অমুসলিম কর্মকর্তা ও শিক্ষক নিয়োগে বাধা থাকাও উচিত নয়। শেষ করার আগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই অধোগতি এবং মুসলমানদের এই অবনতির জন্য দায়ী কে এই স্বাভাবিক প্রশ্নটি আমার মনে জাগে, এর জন্য কি শুধু মুশরিক হিন্দু বা পাশ্চাত্যবাদীরা দায়ী? আমরা নিজেরা কি দায়ী নই? শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার এখন কতটুকু আছে? আমি এখানে দু’টি উদ্ধৃতি দিতে চাই; একটি আল্লামা ইকবালের আরেকটি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও হিন্দী ভাষায় খ্যতিমান কবি অধ্যাপক ড. শংকর দয়াল শর্মার।
আল্লামা ইকবাল বলেছেন,

“হিকমত হুই হামারি উল্লু বনে রহে হাম
জিয়াফত হুই হামারি ভুখছে মর রাহি হাম,
অর্থাৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের ভা-ার আমাদের হাতে
অথচ আমরা অর্থ-মূর্খই রয়ে গেছি
আমাদের বাড়িতে জিয়াফত অথচ আমরা ক্ষুধার্ত”

ড. শংকর দয়ালের কবিতাটির নাম কুরআন শরিফ তিনি কুরআনকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
“আমল কি কিতাব থি দোয়া কি কিতাব বানা দিয়া
সমঝনে কি কিতাব থি পড়নে কি কিতাব বানা দিয়া
জিন্দাওঁ কা দস্তুর থা মুর্দাওঁ কা মনসুব বানা দিয়া
জো ইলম কি কিতাব থি উসে লা-ইলমকে হাথ জমা দিয়া
তশখীরে কায়েনাথ কা দরস দেনে আয়ে থি
স্রেফ মাদরাসোঁ কা নিসাব বানা দিয়া
মুর্দা কত্তমো কো জিন্দা করনে আয়ি থি
মুর্দো কো বখশ ওয়াযনে পের লাগা দিয়া
আয়ে মুসলমানোঁ ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া”
অর্থাৎ আমল করার কিতাব ছিল দোয়ার কিতাব বানিয়ে দিয়েছ
অনুধাবন করার কিতাব ছিল তেলাওয়াত বা পড়ার কেতাব বানিয়ে দিয়েছ
জীবিতদের জীবন বিধান ছিল মৃতদের ইশতেহার বানিয়ে নিয়েছ
যেটা ছিল জ্ঞানের কিতাব সেটা মূর্খদের হাতে ছেড়ে দিয়েছ
সৃষ্টির জ্ঞান দিতে এসেছিল এটি, শ্রেফ মাদরাসার পাঠ্য বানিয়ে দিয়েছ
মৃত জাতিকে বাচিয়ে তুলতে এসেছিল এটি, মৃতের জন্য দোয়ার কাজে লাগিয়ে দিয়েছ
হে মুসলমানরা এটা তোমরা কি করেছ? (সমাপ্ত)

https://dailysangram.com/post/520665