২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৩:৫২

প্রলয় গ্যাংয়ের উৎপাতে সিট পেতেন না রোগীরা

প্রলয় গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারের কর্মচারীরা। সন্ধ্যার পরেই আসা শুরু হতো গ্যাংয়ের সদস্যদের। হৈ-হুল্লোড়, লাফালাফি করতেন সেন্টারের তিনতলাজুড়ে। তাঁদের উৎপাতে তিনতলায় অনেক সময় কোনো রোগীকে সিট দেওয়া যেত না। কোনো কর্মচারী বাধা দিলে চড়াও হতেন তাঁরা।
সেন্টারটির একাধিক কর্মচারী কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানান।

গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে পেটান প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। এর পরই তাঁদের নাম এবং একের পর এক অপকর্মের তথ্য জানা যাচ্ছে। পেটানোর ঘটনায় গ্যাংয়ের সদস্য দুই শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

মেডিক্যাল সেন্টারের কর্মচারীদের ভাষ্য মতে, সেন্টারের তিনতলায় তিনটি ওয়ার্ড। দুটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। তিনটি ওয়ার্ডে ৩০টির বেশি সিট আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা আসা শুরু করতেন। কখনো রোগী সেজে, কখনো কারো রোগীর সঙ্গে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিচয় দিতেন। কখনো জসীমউদ্দীন হল, কখনো বিজয় একাত্তর হল, কখনো জিয়া হলের শিক্ষার্থীর পরিচয় দিতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃতীয় তলায় দায়িত্বরত এক কর্মচারী বলেন, প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের জন্য অনেক সময় রোগীদের সিট দেওয়া যেত না। তাঁরা সন্ধ্যার পর এসেই পুরো চিকিৎসাকেন্দ্রে উৎপাত শুরু করতেন। মদ-গাঁজার গন্ধে তৃতীয় তলায় থাকা যেত না। অনেক সময় গভীর রাতে এসে রুমের তালা খুলতে বলতেন। না খুলতে চাইলে গালাগাল করতেন।

আরেক কর্মচারী বলেন, ‘চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক, নার্স—সবাই প্রলয় গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। গত তিন-চার মাস তাঁরা খুব বেশি উৎপাত করেন। ২৫ থেকে ৩০ জন করে আসতেন। দাপাদাপি করতেন

মেডিক্যালজুড়ে। আমরা অনেকবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। প্রক্টরিয়াল টিম কয়েকবার এসেছিল। বস্তা ভরে তাঁদের মাদক সেবনের সরঞ্জামও নিয়ে গিয়েছিল। অনেক সময় প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের উল্টো ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন গ্যাংয়ের সদস্যরা।’

প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের উৎপাতের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেডিক্যাল অফিসার ডা. হাফেজা জামানের বক্তব্য জানতে গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমাদের নলেজে যখনই বিষয়টি এসেছে, তখনই অভিযান চালিয়েছি। সর্বশেষ সপ্তাহ দুয়েক আগে এ রকম একজনকে পাওয়া গিয়েছিল যে রোগী বা রোগীর সঙ্গের কেউ না হয়েও অবস্থান করছিল। আমরা তত্ক্ষণাৎ তাকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছি।’

প্রক্টরিয়াল টিমকে ধমক দেওয়ার ব্যাপারে প্রক্টর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অপসংস্কৃতি তো আছেই যে অনেক শিক্ষার্থী প্রক্টরিয়াল টিম যে সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে সেটি বুঝতে পেরে, জানতে পেরেও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তাদের ভয় দেখানো বা তাদের প্রতি অসহযোগিতা করা—তারা যে কাজে যায় তাদের বাধা দেওয়া, মিথ্যা তথ্য দেওয়া। এ ধরনের একটা অপসংস্কৃতি ছিল, তবে এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে।’

রনির অনশন থেকে আস্তানা : বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির অনশনের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারকে নিজেদের কার্যালয় হিসেবে রূপান্তর করেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা।

মেডিক্যাল সেন্টারের এক কর্মচারী কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছরের এপ্রিল মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে সেন্টারে আসেন মহিউদ্দিন রনি। কিন্তু তখন চিকিৎসাসেবাসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ এনে ছয় দফা দাবি আদায়ে মেডিক্যালেই অনশনে বসেন তিনি। তখন তাঁর অনশনকে কেন্দ্র করে মেডিক্যালের ওয়ার্ডগুলোতে আসতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী, তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পরিবারসহ অনেকে। তখন থেকেই এই প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের মেডিক্যাল সেন্টারে যাতায়াত শুরু হয়। রনি মেডিক্যাল সেন্টার ছাড়লেও গ্যাংয়ের সদস্যরা একে তাঁদের আস্তানা বানিয়ে ফেলেন।
এদিকে শনিবারের পর থেকে প্রলয় গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলেও মহিউদ্দিন রনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ নামের ফেসবুক গ্রুপে তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে মহিউদ্দিন রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার অনশনের পর তারা মেডিক্যাল সেন্টারে যাতায়াত শুরু করেছিল, এটা আজকে এক বছর পর জানানো হচ্ছে আমার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচিকে বা এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।’

ফেসবুকে মন্তব্যের বিষয়ে রনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এদের সাময়িক একটা সাজা দেয়। কিন্তু তাদের রিহ্যাবের কোনো ব্যবস্থা করে না। তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কোনো ব্যবস্থা করে না। আমি মূলত তাদের যে সংশোধনের জন্য রিহ্যাব, গ্রুমিং ও মনিটরিং প্রয়োজন, সেটি তুলে ধরতেই এ নিয়ে কথা বলেছি।’

১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন : প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুনকে আহ্বায়ক ও সহকারী প্রক্টর এম এল পলাশকে সদস্যসচিব করে আন্ত হল তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে উপাচার্য বরাবর প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুই সদস্য সাময়িক বহিষ্কার : গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজন শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান মঙ্গলবার সাময়িক বহিষ্কারের এই অনুমোদন দেন।

বহিষ্কৃত দুই শিক্ষার্থী হলেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ ও স্যার এ এফ রহমান হলের মো. সাকিব ফেরদৌস এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগ ও কবি জসীমউদ্দীন হলের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান দুর্জয়। দুজনই ২০২০-২১ সেশনের ছাত্র।
সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না’ মর্মে পত্রপ্রাপ্তির সাত কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে।

গত শনিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের সামনে স্যার এ এফ রহমান হলের অনাবাসিক ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে মারধর করেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনার পর জোবায়েরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হামলার ঘটনায় তাঁর মা সাদিয়া আফরোজ খান গত রবিবার রাতে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। এজাহারে জোবায়েরকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যে মারধরের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় ১৯ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো ছয়-সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পর এজাহারভুক্ত আসামি নাইমুর রহমান দুর্জয় এবং ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. সাকিব ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সোমবার তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।


 

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/03/29/1265764