২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৩:৫১

ঢাকার বায়ু দূষণে দায়ী ভারত

বিশ্বের বায়ু দূষণের তালিকায় রাজধানী ঢাকা শহর প্রায় শীর্ষে থাকে। এই বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে গেছে যে ঢাকা বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। আর ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ভারত। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের ঢাকা শহরের দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে পাশের দেশ ভারত থেকে। ফলে বায়ুদূষণ রোধে দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বাড়াতে হবে। নিজ দেশের ভেতরের বায়ু দূষণের উৎস বন্ধেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার দরকার।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। গবেষণায় বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার দরকার বলে মন্তব্য করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যাচ্ছে। ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়েও আশ্রয় নিচ্ছে, যা এই দেশগুলোতে দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিজ দেশের ভেতরের দূষিত বায়ুর পাশাপাশি অন্য দেশগুলো থেকে আসা বায়ুর কারণে মানুষ নানা রোগ-বালাই ও কষ্টে ভুগছে।

‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা, দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মান মাত্রার চেয়ে এখানকার শহরগুলোর বায়ু ৬ থেকে ২৫ গুণ মান খারাপ। ঢাকা ওই দূষিত শহরের মধ্যে অন্যতম শীর্ষে ঢাকা শহর। আর ঢাকার দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ঢাকার বাইরের শহরগুলো থেকেও ৪০ শতাংশ দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।

গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে যত অকালমৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। ধারাবাহিক শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, ক্যানসার, হৃদরোগ ও কোভিড-১৯-এর মতো রোগ বায়ুদূষণের কারণে ছড়িয়ে পড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়। ফলে দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক এবং সহযোগিতা বাড়াতে না পারলে বায়ুদূষণ রোধ করা কঠিন হয়ে যাবে

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যাবডউলাই সেক বলেন, গবেষণা অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতি নিলে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ বায়ুদূষণ রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ ও আইন প্রণয়ন করেছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়। ফলে দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক এবং সহযোগিতা বাড়াতে না পারলে বায়ুদূষণ রোধ করা কঠিন হয়ে যাবে।

বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর-এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে যত অকালমৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে।

বিশ্বব্যাংক জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ এবং জনস্বাস্থ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চলে কিছু সূক্ষ কণা, যেমন-কাচ এবং ছোট ধূলিকণার ঘনত্ব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবছর আনুমানিক ২ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটায়। এই ধরনের চরম বায়ু দূষণের সংস্পর্শে শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং এবং হ্রাসকৃত জ্ঞানীয় বিকাশ থেকে শুরু করে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী ও দুর্বল রোগের প্রভাব রয়েছে। এতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধিসহ দেশের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং কর্মঘণ্টা নষ্ট করে।

বিশ্বব্যাংক আরো জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি প্রধান এয়ারশেড চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে বাতাসের গুণমানে আত্মনির্ভরতা বেশি। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে বিস্তৃত একটি সাধারণ এয়ারশেড শেয়ার করে। প্রতিটি এয়ারশেডের কণা বিভিন্ন উৎস এবং অবস্থান থেকে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা, কাঠমন্ডু এবং কলম্বোর মতো অনেক শহরে, শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ বায়ুদূষণ শহরের মধ্যে উৎপন্ন হয়। বায়ু দূষণের আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে, চারটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ-বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান প্রথমবারের মতো ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি এবং হিমালয়ের পাদদেশে বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য কাঠমান্ডু রোডম্যাপ তৈরি করতে একমত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমই-এর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ঢাকা শহরের বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। আমি নিজে গুলশানের একটি পার্কে হাঁটতে যাই। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে নিয়মিতভাবে ঠান্ডা-কাশিতে ভুগছি। ঢাকার ভেতরের বায়ুদূষণ বন্ধ করার পরও বায়ু নির্মল হবে না। কারণ, ভারত থেকে দূষিত বায়ু ভেসে আসা ঠেকানো তো ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে হবে।

স্থপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে এখন নির্মাণকাজ। সরকার আইন করে পোড়ানো ইট পর্যায়ক্রমে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। ব্লক ইট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই এখন পর্যন্ত তা ব্যবহার করছে না; বরং সরকারি প্রকল্পগুলো বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের রিজিওনাল ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া ইন্ট্রডেশন সিসিলি ফ্রুম্যান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মোট ছয়টি অভিন্ন মেঘমালা (এয়ারশেড) রয়েছে। যেগুলো এখানকার চারটি দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ওই মেঘমালার কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বায়ুদূষণের উৎস কম থাকলেও অন্য এলাকা থেকে দূষিত বায়ু এসে ঢাকা, কাঠমান্ডু ও কলম্বো শহরকে দূষিত করছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ উৎস বন্ধ করতে হবে। আবার অন্য দেশ থেকে দূষিত বায়ু যাতে না আসে, সে জন্য ওই দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে পরিবেশ অধিদফতর বায়ুদূষণ রোধে কাজ করছে। দেশের ভেতরের বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধে এরই মধ্যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা এবং কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, এমন যানবাহনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইয়েন জু ই-এর সঞ্চালনায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা বায়ুদূষণ বিষয়ে বক্তব্য দেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/565301