২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৩:৩৪

ব্রহ্মপুত্রে ভারতের অসংখ্য প্রকল্প বিপর্যস্ত বাংলাদেশের যমুনা

সরদার আবদুর রহমান: ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ভারতের অসংখ্য প্রকল্প টেনে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ পানি। এতে প্রবাহ হ্রাস পেয়ে চলেছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী যমুনার। ফলে শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারতের তৈরি অসংখ্য প্রকল্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের যমুনায় চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। এর ফলে যমুনায় পানির উচ্চতা ও প্রশস্ততা হ্রাস পেয়ে চলেছে। এতে এখানকার কৃষি, নৌ-চলাচল, মৎস্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর অন্যতম। তিব্বত, চীন, ভারত ও বাংলাদেশের ভূখ-জুড়ে রয়েছে এর অববাহিকা অঞ্চল। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান শাখা। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদের নি¤œ প্রবাহ যমুনা নামে অভিহিত। ১৭৮৭ সালের আগে যমুনার বুকে কোনো নদী ছিল না। জোনাই খাল নামে একটি ছোট্ট স্রোতধারা ছিল। ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের মূলস্রোত পরিবর্তিত হয়ে এই খালটির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে। খালটির নাম হয় তখন যমুনা। ১৭৮৭ সালে আরেকটি বড় বন্যায় তিস্তা নদীর একটি বড় স্রোত যমুনায় যোগ দেয়। ফলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, জোনাই খাল সবকটির স্রোত মিলে সুবিশাল নদী হিসেবে যমুনার আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশ ভূখ-ে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৫ কিলোমিটার। যমুনার প্রশস্ততা তিন থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত, তবে এর গড় প্রশস্ততা প্রায় ১০ কিলোমিটার। বাংলাদেশে অবস্থিত যমুনার প্রবাহপথের বেশির ভাগ স্থানেই অসংখ্য চর গড়ে উঠেছে, যেগুলো বর্ষা ঋতুতে ডুবে যাওয়ার ফলে নদীটি একটি একক খাতে পরিণত হয়। এভাবে শুধু প্রশস্ততার কারণে নদীটি বিশ্বের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীতে পরিণত হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে গত ৩৫ বছরে ৭২০ বর্গকিলোমিটারের বেশি নতুন নতুন চর পড়েছে এবং একই সময়ে এর তলদেশ ভরাট হয়েছে প্রায় ২২ ফুট। জানা গেছে, আদি অবস্থায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গড়ে প্রশস্ততা ছিল প্রায় ১১ কিলোমিটার। বর্তমানে এর প্রশস্ততা এখন ১২০ মিটার থেকে ২২০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খনন না করায় নদের বুকে পলি ও বালু জমে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে নদের দুই পাড়ের ফসলি জমিতে প্রতি বছর সেচ সংকট দেখা দেয়।

ভারতের অসংখ্য বাঁধ ও প্রকল্প
বিভিন্নসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের উজানে ব্রহ্মপুত্র নদে এর প্রায় সবগুলো উপনদীতে অসংখ্য বাঁধ ও প্রকল্প নির্মাণ করেছে ভারত। ব্রহ্মপুত্রে ভারতের অন্তত ২১টি সেচ প্রকল্প রয়েছে। এসব সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষত আসামের বিস্তীর্ণ জমিতে পানি সেচ দেয়া হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে একটি পশ্চিমবঙ্গে এবং একটি নাগাল্যান্ডে অবস্থিত। বাকিগুলো রয়েছে আসামে। ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের অন্যতম প্রধান উৎসগুলোর একটি সংকোশ নদীর ওপর একটি বাঁধ নির্মাণের জন্য ভুটান সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ১৪৩ কি.মি. খাল খনন করা হবে। এ খাল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে ফারাক্কায় অতিরিক্ত ১২ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহ করবে। পানির সাথে বাড়তি পাওনা হবে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উৎস রাঙ্গানদীর উপর ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। অরুণাচল প্রদেশের সুবানসিঁড়ি জেলায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এই বাঁধ নির্মিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎস পাগলাদিয়ায় একটি বিশাল বাঁধ নির্মিত হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্ধলক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান ও কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। আসামের লংকা থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী খানডং-এ ৬৬ মিটার উচ্চতার একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এই বাঁধের সাহায্যে একদিকে ১২৫৬ বর্গকি.মি. এলাকায় সেচ এবং ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এজন্য কয়েকটি পানি সংরক্ষণাগারও নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের আরেক বৃহৎ উপনদী ডিহিং (বুড়ি ডিহিং) নদীতে সিয়াং বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের আরেক উপনদী কালসি নদীতে বহুমুখী বাঁধ নির্মাণ করায় ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। আসাম ও মেঘালয়ের সীমান্ত গ্রাম উকিয়ামের দেড় কি.মি দূরে এর কাজ চলছে। এই বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে একাধারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান এবং ৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হবে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস রাইডাক নদীতে ভুটান-ভারতের যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ একটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের আরেক উৎস লাংপি নদীতে নির্মিত ‘কারবি-লাংপি’ প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে ভারত ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস কপিলি নদীকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ কয়েকটি বাঁধ ও রিজার্ভার নির্মাণ করেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন এই বাঁধ প্রকল্পের লক্ষ্য। এই নদীর আরেক উৎস সুবানসিড়ি নদীর পানি প্রত্যাহারসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছে ভারত। নাগাল্যান্ডে ডয়াং নদীর উপর নির্মিত একটি ড্যাম ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ৭৫ মেগাওয়াট পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। আরেক উৎস উমিয়াম নদীতে মেঘালয়ের রাই-ভই জেলায় বাঁধ দিয়ে অন্তত চারটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে ভারত। অরুণাচল প্রদেশের চাংলাং জেলার মিয়াও শহরের চার কি.মি দূরে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী ডিহিং নদীতে নও ডিহাং বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে। অপর উপনদী দিবাং-এর উপর ‘আপার সিহাং হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট’ নামে একটি বৃহদাকার বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া
এসব প্রকল্পের কারণে ব্রহ্মপুত্রের পানি-প্রবাহের বেশির ভাগ ভারতের অভ্যন্তরেই প্রত্যাহার হয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়া যমুনার উপর পড়ে ভয়ানক রকম। যমুনাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের বহু বিস্তীর্ণ জনপদে পানির হাহাকার শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। তথ্যে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর তীরবর্তী চৌহালী, শাহজাদপুর, বেলকুচি, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার অধিকাংশ স্থানে চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। ভরা মৌসুমে যেখানে পানিতে ভরপুর ছিল আজ সেখানেই জেগে উঠেছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। জেগে ওঠা এ জমির মালিকেরা বালুচরে বাদাম, কলাই, সরিষা, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করছেন। ফসল চাষের জমি জেগে উঠলেও যমুনার সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও বিস্তীর্ণ চরের উত্তাপে তীরবর্তী জনপদের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, শীত এলেই নদীর বুকজুড়ে জেগে ওঠে চর ও আবাদি জমি। এসব জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকে। এখন যমুনায় অসংখ্য চর ও ফসলি জমি জেগে উঠেছে এবং যোগাযোগের ব্যবস্থাও খারাপ। এছাড়া পানি কমে যাওয়ায় নৌ-শ্রমিক এবং জেলেরা এখন প্রায় বেকার। উত্তরের জেলাগুলো থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বর্তমানে সর্বনি¤œ স্তরে নেমে এসেছে। অতীতে কখনোই এ মৌসুমে এত আগে এভাবে ব্রহ্মপুত্রের পানি শুকিয়ে যায়নি। ফলে নৌচলাচল রুটগুলোতে জমেছে বড় ধরনের বালুচর। প্রায় একই অবস্থা যমুনা নদীতেও। অগ্রহায়ণ-মাঘ মাসেই ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জেগেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। বালাসী ঘাটের প্রবেশ পথে ব্রহ্মপুত্র নদের কালাসোনা টানিং পয়েন্ট নৌচ্যানেল ভরাট হয়ে পড়েছে। বালাসী ফেরিঘাট চালু থাকা অবস্থায় প্রতি বছর ড্রেজিং করে ফেরি ও নৌরুটের কাজ করা হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ থাকায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার প্রায় ২০টি নৌঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় ফুলছড়ি নৌবন্দর পাট ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পার্শ্ববর্তী বালাসীঘাট নৌবন্দর ছিল বিশাল তেলের ডিপো। এই দুই নৌবন্দরে নিয়মিত জাহাজ ভিড়তো। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিশাল এলাকাসহ নদীতে হারিয়ে গেছে বন্দরগুলোর মূল কাঠামো। এ অবস্থায় পানি হ্রাস পেয়ে নদীর বুকে চর জেগে নৌযান ও জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় বন্দরের কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। অপরদিকে দ্রুত পানি হ্রাস পাওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব চ্যানেল জিগাবাড়ী থেকে জামিরা পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকায় ছোট-বড় দুই শতাধিক চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। এতে ফুলফড়ি উপজেলার অভ্যন্তরীণ নৌরুটগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও নৌ-যোগাযোগের উপর।

https://dailysangram.com/post/520623