২৮ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:৫৯

তীব্র যানজটে রাজধানী অচল

দুপুরের আগে অফিসের কাজে বেরিয়েছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মাহমুদুল হাসান। বিকাল তিনটায় মোটরসাইকেলে করে নিউ মার্কেটের পথে যেতে মহাখালীতে এক জায়গাতেই টানা ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। “এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা, আমি মিন্টো রোডে। বাইক বন্ধ করে বসে আছি। মনে হচ্ছে আজ বাসায় ইফতার করতে পারব না। ভয়াবহ যানজট।” বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে যখন তার সঙ্গে কথা হয় তখন মিন্টো রোড, বেইলি রোড, কাকরাইল মোড়জুড়ে তীব্র যানজটে বাইক নিয়ে এগোনোর কোনো উপায় নেই। শুধু সেই অংশ নয়, অদূরে মগবাজার ছাড়িয়ে হাতিরঝিল, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বাড্ডাসহ পুরো নগরীর সড়ক যেন দুপুরের পর স্থবির হয়ে যায়। বিকাল সাড়ে তিনটায় বারিধারা থেকে রওনা দিয়ে লাবণ্য আরশি মগবাজারে পৌঁছেছেন ঠিক ছয়টার কিছু আগে। অথচ এ পথে তার বাসায় ফিরতে সময় লাগে বড়জোর পৌনে এক ঘণ্টা। পুরো গুলশান আর হাতিরঝিলে যেন গাড়ি নড়ছিলই না, এক জায়গাতেই ঠাঁয় দাঁয়িয়ে অনেকক্ষণ। উবারের ভাড়া গুণতে হয়েছে দুইশ টাকা বেশি, সঙ্গে ছিল ইফতার তৈরির একগাদা দুশ্চিন্তা।

গতকাল সোমবার টানা তিনদিন ছুটির পর অফিস খুললে সকাল থেকেই সড়কে গাড়ি জট পাকাতে থাকে; তা দুপুরের পর দীর্ঘ হতে হতে বিকালে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা যেন ভেঙ্গে পড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য। ট্রাফিকের দায়িত্বরতরাও শত চেষ্টা চালিয়েও নিরুপায় হয়ে পড়েন। কোনোভাবেই জট খুলছিল না।

রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ ব্যস্ততম মোড়গুলোতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি; অনেক স্থানে ভিড় এতটাই বেশি ছিল যে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করবেন, সে অবস্থাও ছিল না। তীব্র এ যানজটে গন্তব্যে পৌঁছাতে নাভিশ্বাস উঠেছে পথে থাকা মানুষের। অনেকে সময়মত ইফতারও সারতে পারেননি। চলতি পথেই রোজা ভাঙতে হয়েছে তাদের।

এদিন রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যানবাড়ি থেকে আর্মি স্টেডিয়াম, রামপুরা, হাতিরঝিল, মগবাজার, মহাখালী থেকে বিজয় সরণি, ফার্মগেইট থেকে বিজয় সরণি হয়ে মহাখালী, সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও হয়ে মহাখালী পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজট ছিল। মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, পল্টন প্রতিটি সড়কেই যানবাহন মোটামুটি স্থবির। এছাড়া গুলশান ও বনানী এলাকার বিভিন্ন সড়কে দুপুরের পর যানজট তীব্র হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, এদিনের যানজট ছিল মূলত মহাখালী, বনানী ও গুলশানকেন্দ্রিক। পরে তা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিমানবন্দর সড়কের আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান রোড সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কের পাশের ফুটপাত ও ড্রেনেজের উন্নয়ন কাজ চলছে। এছাড়া মহাখালী থেকে গুলশান যাওয়ার সড়কেও কাজ চলছে। এসব কারণে যানজট তৈরি হয়েছে।

অফিস ফেরত পথচারীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি বাস ও সিএনজি অটোরিকশা চালকদের হতাশা ছিল ঠিকমত ভাড়া না পাওয়া নিয়ে। এক ট্রিপে অনেক সময় নষ্ট হওয়ায় দিনের গাড়ির জমা তোলা নিয়েই শঙ্কার কথা বলেছেন তারা।

বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে গুলশান দুই নম্বর এলাকায় কথা হয় সিএনজি অটোরিকশা চালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। রামপুরা থেকে যাত্রী নিয়ে গুলশানে আসতে তার লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। “প্রথমে হাতিরঝিল দিয়া আসতে চাইলাম। কিন্তু প্রচ- জ্যাম, যেই রাস্তায় ঢুকি সেইটাই প্যাকেট হইয়া আছে। পরে ঘুইরা বাড্ডা দিয়া গুলশানে আইছি।”

দুপুরের পর মহাখালী এলাকা যানজটে আটকে থাকা বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসের চালক আনোয়ার হোসেন তিনটার দিকে বলেন, “সকাল থেকে তিনটা পর্যন্ত দুইবারে চার সিঙ্গেল ট্রিপ মারি। কিন্তু আজ এ পর্যন্ত দুই সিঙ্গেল মারলাম। রামপুরায় অনেক জ্যাম, এ কারণে গুলশান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে দিতেছি।”

হাতিরঝিল এলাকায় যানজটে আটকে থাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক রহিম উদ্দিন কালু বলেন,” বেলা আড়াইটায় মগবাজার থেকে গুলশান এক নাম্বারের যাত্রী উঠিয়েছি। প্রায় দুইঘণ্টা ধরে হাতিরঝিলে বসে আছি। এখন বাজে ৫টা, কখন পৌঁছাব জানি না। গ্যাসও ফুরিয়ে আসছে। তিন‘শ টাকার খেপ নিয়ে কোনো লাভও হবে না।”
বিমানবন্দর সড়কে সকালের দিকে যান চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। তবে দুপুরের পর গাড়ির চাপ বাড়তে থাকলে সেখানেও যানজটে পড়তে হয়।

গাবতলী থেকে রামপুরা রুটের আলিফ পরিবহনের সহকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, দুপুরের পর যানজট হয়েছে বেশি। “সকালে যানজট তেমন ছিল না। সাড়ে বারোটার দিকে গাবতলী থেকে রওনা হয়েছি। সেসময়ও মিরপুরের দিকে তেমন জ্যাম ছিল না। কিন্তু বনানী ফ্লাইওভারে আইসা আটকে গেছি। অনেকক্ষণ ধরে এখানেই বসে আছি।”

সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হওয়া চালক আকবর আলী বলেন, “সকালে অফিস সময় মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় হালকা জ্যাম ছিল, ওইটা নিয়মিত থাকে। এরপর আর কোথাও জ্যাম দেখি নাই। কিন্তু এখন বনানী থেকে জ্যাম শুরু হইছে।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মী মো. শামীম আহমেদ বলেন, প্রতিদিন সকালে গোপীবাগের বাসা থেকে বের হওয়ার পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গুলশানে চলে আসেন। কিন্তু গতকাল সোমবার অফিসে আসতে সময় লেগেছে আড়াইঘণ্টার মতো। “মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে নেমে আবুল হোটেলের কাছে জ্যামে পড়েছি। সেখানে ১০ মিনিটের মতো আটকে ছিলাম। রামপুরা থেকে হাতিরঝিল পার হয়ে শুটিং ক্লাব পর্যন্ত আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। আজকে এত জ্যাম হইলো কেন বুঝতে পারছি না।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিবুর রহমান বলেন, গতকাল যানজট মহাখালী, বনানী ও গুলশানকেন্দ্রিক। পরে তা অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দর সড়কের মহাখালী থেকে গুলশান যেতে সড়কের একটি অংশ বন্ধ থাকায় জাহাঙ্গীরগেট থেকে আসা যানবাহন যেতে মহাখালীর দিকে যেতে পারছে না। একই কারণে বিমানবন্দর সড়ক এবং গুলশান ও বনানীর ভেতরের সড়কগুলোয় গাড়ির চাপ বেড়েছে। “গুলশানে যানজট তৈরি হওয়ায় বাড্ডা থেকেও যানবাহন গুলশানে যেতে পারছে না। এই কেন্দ্রিক যানজট ছড়িয়ে পড়েছে। মুখটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটা জটলা তৈরি হয়েছে। তেজগাঁও, বাড্ডা, হাতিরঝিল সব এলাকায় যানজট হয়েছে।”

https://dailysangram.com/post/520520