২৮ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:৫৩

সংকটের কবলে শিক্ষা ব্যবস্থা : সাধারণ শিক্ষা

-ড. মো. নূরুল আমিন

শিক্ষা হচ্ছে উপকারী জ্ঞান পরিবেশনের একটি বাহন। মানুষের বাচ্চার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয়। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। সুশিক্ষা যেমন মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হতে সহায়তা করে তেমনি কুশিক্ষা মানুষকে পশুত্বে নামিয়ে আনে। মহান রাব্বুল আলামীন শনিবারের নিয়ম অমান্য করায়, একটি জাতি গোষ্ঠীকে মানুষ থেকে বানরে রূপান্তরিত করার ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। আমাদের দেশে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের নৈতিক অবনতি দেখে একজন কবি একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গেট দিয়ে পশুর বাচ্চা হয়ে বেরিয়ে আসছে। নৈতিক শিক্ষাও মূল্য বোধের অভাব এবং নৈতিক স্খলন প্রধানত এর জন্য দায়ী।

যে কোন দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। দুর্ভাগ্যবশত: আমাদের দেশে তা নেই। আমাদের শিক্ষার সংজ্ঞা ও নেই। আমরা কি ধরনের মানুষ তৈরি করতে চাই তাদের দেশপ্রেম, নৈতিক মান ও কি ধরনের মানবিক মূল্যবোধের তারা অধিকারী হবেন, কি ধরনের দক্ষতা ও কর্মকুশলতার তারা অধিকারী হবেন, শিক্ষার সংজ্ঞাই তা বলে দেবে।

বৃটিশরা প্রায় পৌনে দুশ’ বছর আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে। আমাদের দেশের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মাদরাসার আলীয়ার অংশ বিশেষ করে তাদেরই অবদান। শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা Double standard মেনে চলতেন, একটা ছিল উপনিবেশগুলোর জন্য আরেকটি বৃটেনের স্বাধীন নাগরিকদের জন্য, উপনিবেশ আমলে যখন ভারতবর্ষে আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল তখন Lord Mclay ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। হাউজ অব কমনস্-এ তিনি শিক্ষাব্যবস্থা introduce করতে গিয়ে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার preamble এ বলেছিলেন, we must try our best to form a class of people who will be best interpreters between us and the millions whom we govern, a class of people who will be indians in blood and color but english in all aspects of their lives, কার্যতঃ এ ব্যবস্থা আমাদের দেশে এক শ্রেণীর কেরানীই সৃষ্টি করেছিল, এখনো করছে, স্বাধীন মানুষ নয়।

অন্যদিকে স্বাধীন বৃটিশ জাতির জন্য তারা এই শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির ভার দিয়ে ছিলেন, British manpower comminison কে এই কমিশন শিক্ষার একটি সংজ্ঞা, লক্ষ্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করে যে ডকুমেন্টটি তৈরি করেছিল তা হচ্ছে. “Education is defined as activities which aim at developing the knowledge, skills, moral values and understanding required in all aspects of life rather than a knowledge and skill relating to only a limited field of activities. The purpose of education is to provide the condition essential to young people and adults to develop an understanding of the traditions and ideas influencing the society in which they live and to enable them to make a contribution to it. It involves study of their own religion and culture and of the laws of nature as well as the acquisition of linguistic and other skills which are basic to larning, personal development, creativity and communication.

অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে ঐ সব কার্যকলাপ বা কর্মকান্ড যার উদ্দেশ্য মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মকুশলতা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর উন্নয়ন সাধন, শুধুমাত্র সীমিত কোন ও জ্ঞান বা দক্ষতা নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে সমাজে মানুষ বসবাস করে সে যুবক হোক কিংবা প্রৌঢ়, সেই সমাজকে উন্নয়ন ও উপলব্ধিতে তাকে সহায়তা করা ও দক্ষ করে তোলা যাতে করে এ সব ক্ষেত্রে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। তার নিজের ধর্ম, কৃষ্টি কালচার, প্রাকৃতিক আইন, ব্যক্তি উন্নয়ন, সৃজনশীলতা যোগাযোগ ও পারস্পারিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা, গণনা ও ভাষা শিক্ষা প্রভৃতি শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

বৃটিশ ম্যানপাওয়ার কমিশন প্রদত্ত শিক্ষার সংজ্ঞাটি অত্যন্ত পরিষ্কার। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে তারও যে জ্ঞান, দক্ষতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, ধর্ম সংস্কৃতি, সৃজনশীলতা বিজ্ঞান, মানুষের সাথে মানুষের সম্পক ও যোগাযোগ, ব্যক্তি উন্নয়ন তথা সামগ্রিক জ্ঞানের জন্য যে শিক্ষা দরকার সব কিছু এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কনাডা অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন প্রভূতি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমার কিছুটা পরিচিতি হবার সুযোগ হয়েছে। তারাও বৃটিশদের ছাছে তাদের শিক্ষাকে ঢালাই করার চেষ্টা করেছে, আমাদের মতো সংজ্ঞাহীন শিক্ষার তারা অনুসরণ করে না।

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু জ্ঞান পরিবেশন? প্রাচীন ভারতের বৈদিক শিক্ষাবিদরা ও তা বিশ্বাস করতেন না, যেমন করতেন না শিক্ষাকে উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা। এ ব্যাপারে British manpower commission এর সংজ্ঞাটি আমার কাছে অনেকটা ব্যাপক ও বোধগম্য বলে মনে হয়েছে। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা ও খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন মরহুম মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র) ১৯২৩ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আরো সুন্দরভাবে এর ব্যাখা করেছেন, তার ভাষায়, The main duty of education or for that matter of a teacher is not only to impart knowledge. for, a few rupees will buy more printed knowledge than a man’s brain can hold. It is to educate character, faculties and activities so that the children of even those parents who are not thoughtful themselves may have a better chance to become thoughtful parents of the next generation, and to this end should flow our national wealth.”

শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে বিতর্ক চলে আসছে। এখন তো মানুষের পরিবর্তে কুকুরকে ও বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

আমি শিক্ষাবিদ নই; তবে মুসলমান হিসেবে জ্ঞানার্জনকে ফরজ কাজের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি। সভ্য দুনিয়ার বহু দেশে এখন Continuous education পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিটি প্রকৃত পক্ষে ইসলামেরই উদ্ভাবন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানান্বেষণ কর (seek knowledge from the cradle to the grave) এই হাদিসেরই অনুরনন, এখন বৈদিক ভারতের শিক্ষা ও অধ্যাপক কুকুর সম্পর্কে কিছু বলি।

অধ্যাপক বিউরিগার্ড টায়ারবাইটারের কথা পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে। জাতে ডুডল প্রজাতির একটি কুকুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস্ অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০১৬ সালে তাকে পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল দুই বছর। অধ্যাপক কুকুরটি ইউনিভার্সিটি হেলথ সেন্টারের দোতলায় বসবাস করে। এটি তার অফিস কাম রেসিডেন্স। তার কাজ হচ্ছে পরিশ্রান্ত ও রুগ্ন ছাত্রছাত্রীদের আদর সোহাগ ও মনোরঞ্জন করা এবং তার ব্যবস্থা করা। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিফরম এবং বিজনেস কার্ডও দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। খবরটি বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

মানব সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এতকাল শুধু মানব সন্তানরাই অধ্যাপনা করেছেন। এবার পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ও শক্তিমান দেশ আমেরিকা একটা কুকুরকে মানব সন্তানদের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিল। এই কয় বছরে তার পারফরম্যান্স কেমন ছিল, তার কুকুর সুলভ আচরণ ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছিল কিনা অথবা মানব সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে তার নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারের তিনি কোন পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন কিনা তা জানতে ইচ্ছে করে। আমাদের দেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক সম্প্রতি ইসলামী কৃষ্টি কালচার বিশেষ করে আসসালামু আলাইকুম ও আল্লাহ হাফেজ নিয়ে কটূক্তি করে কোটি কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার ফলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে দুই প্রজাতির অধ্যাপকের আচরণ তুলনা করতে ইচ্ছে করে। এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি।

মানুষের ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে জ্ঞান ও বিদ্যা চর্চা ছিল একটি পবিত্র সাধনা। এতে লোভলালসা কিংবা হিংসা বিদ্বেষের স্থান ছিল না। তবে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক চলছে কমপক্ষে দু’হাজার বছর ধরে। এই বিতর্ক প্রথম শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। সেখানে শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে তিন ধরনের মতবাদ ছিল। এক ঘরানার দার্শনিকরা মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন। কাজেই অর্থের বিনিময়ে জ্ঞান দান অসমীচীন। আরেক ঘরানার দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে বিদ্যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত আয় বাড়িয়ে দেয়, কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেয়া ন্যায়সঙ্গত। তৃতীয় মতবাদের প্রবক্তারা মনে করতেন যে বিদ্যার জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে তবে বিদ্যাকে অর্থের দাসে পরিণত করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

প্রথম মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন সক্রেটিস। তার মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য আত্মার বিকাশ, কাজেই অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিক্রয় পাপ, এই জ্ঞান বিক্রেতারা জ্ঞান জগতের গণিকা। আরেক দার্শনিক প্রোটাগোরাস হচ্ছেন দ্বিতীয় মতবাদের প্রবক্তা। তার মতে বিদ্যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তব জীবনের সাফল্যের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। তাই তিনি বিদ্যার্থীদের গার্হ্যস্থ ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, ভাবের কার্যকর প্রকাশ, রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্যকভাবে উপলব্ধি ও পরিচালনা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষায়বলীর বিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। তৃতীয় মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন এরিষ্টিপাস। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, বিদ্যার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যও নয় ঐশ্বর্যও নয়। বিদ্যা আমাদের শিক্ষা দেবে কিভাবে এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়। আমাদের কোন কোন অধ্যাপকের পছন্দের দেশ ভারতের প্রাচীন মনুস্মৃতিতে তিন ধরনের শিক্ষকের উল্লেখ রয়েছে। এর সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে উপাধ্যায়। বাংলার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণরা এই উপাধ্যায় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ওয়েন্ডি এন্ড স্মীথের The Laws of Manu অনুযায়ী বর্ধমান জেলার চট্ট বা চাটুতি গ্রামের উপাধ্যায়রা হলেন চট্টোপাধ্যায়, গাঙ্গুল গ্রামের ব্রাহ্মণরা হলেন গাঙ্গুলী, বন্দ্য গ্রামের উপাধ্যায়রা বন্দোপাধ্যায়, মুখোটি গ্রামের ব্রাহ্মণরা মুখোপাধ্যায়। মনুস্মৃতি অনুযায়ী উপাধ্যায়ের দু’টি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত: এরা জীবিকা অর্জনের জন্য পড়িয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত: এরা সম্পূর্ণ বেদ পড়াতে পারেন না, বেদের অংশ বা বেদ পাঠের সহায়ক গ্রন্থসমূহ পড়িয়ে থাকেন। মনুস্মৃতি অনুসারে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষকরা হলেন আচার্য। মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৪০ নং শ্লোকে আচার্যের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তিনি হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি বেদের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন, আনুষ্ঠানিক গ্রন্থাদিসহ বেদ পড়ান। সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষক হলেন গুরু। যে পুরোহিত আচার অনুষ্ঠান পালন করেন এবং শিশুর অন্ন প্রাসন করেন তিনি হলেন গুরু। গুরু হচ্ছেন মাতা পিতার মত শ্রদ্ধেয়। পশ্চিম বাংলার নাটক নভেল প্রত্যেকটিতেই পূজা অর্চনা এবং এই গুরুদের অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা আজো রয়েছে। উপাধ্যায় থেকে শুরু করে গুরু পর্যন্ত সকলেই কিন্তু ধর্মপ-িত। ধর্মাশ্রিত সমাজেরই তারা একটি অংশ। পশ্চিমা শিক্ষা আমাদের যেমন ধর্মচ্যুত করেছে তাদের কিন্তু সে রকম পারেনি। ফলে মুসলিম নামধারীরা যত সহজে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে আঘাত করতে পারে, হিন্দুরা তাদের ধর্মকে তত সহজে পারে না।

পবিত্র কুরআন মুসলমানদের সর্বোত্তম জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সূরা আল ইমরানের ১১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, দুনিয়ার মানুষের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ কর, অন্যায় ও মন্দ কাজে নিষেধ কর।”

অনুরূপভাবে সূরা আল ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে একদল লোক অবশ্যই এমন থাকবে যারা সব সময় কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে ও লোকদিগকে ভাল কাজের আদেশ দিবে, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। প্রকৃতপক্ষে এরাই সাফল্যম-িত হবে।”

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে বিধৃত মানব জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ণয় করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান পরিবেশন নয় বরং মানুষ সৃষ্টির বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে চরিত্র গঠন, মেধার বিকাশ ও সামগ্রিক চালচলন, কাজকর্ম প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের উপযোগী সংযম ও সমন্বয়ের শিক্ষা প্রদান।

কারুর সাথে সাক্ষাৎ হলে, নিজ গৃহে ও অপরের গৃহে প্রবেশ করলে সালাম দেয়া, অনুমতি গ্রহণ অথবা আল্লাহ হাফেজ বলা ইসলামী সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ। ভিন্ন কৃষ্টির প্রভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে এর যদি বিকৃতি ঘটে থাকে এবং কোন দল তা তার শুদ্ধরূপে নিয়ে থাকে তাহলে তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত; তার পরিবর্তে তাদের জঙ্গী বলা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জলাতঙ্কের ন্যায় যারা ইসলাম আতঙ্কে ভোগেন, তারা ইসলামী আচার-আচরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুর মধ্যেই জঙ্গীবাদ খুঁজে বেড়ান। তারা নামে মুসলিম ও শিক্ষিত বলে নিজেদের দাবি করলেও না জানেন ইসলাম, না জানেন শিক্ষা-সংস্কৃতি। বিষয়টি আরেকটি পরিষ্কার করে নেই।

শিক্ষার একটি সার্বজনীন সংজ্ঞা আছে। এই সংজ্ঞাটি বৃটিশ ম্যান পাওয়ার কমিশন কর্তৃক প্রণীত। এতে বলা হয়েছে, “Education is defined as activities which aim at developing the knowledge, skills moral values and understanding required in all aspects of life rather than a knowledge and skill relating to only a limited field of activities. The purpose of education is to provide the conditions essential to young people and adults to develop an understanding of the traditions and ideas influencing the society in which they live and to enable them to make a contribution to it. It involves study of their own religion and culture and of the laws of nature as well as the acquisition of linguistic and other skills which are basic to learning, personal development, creativity and communication.”

অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে জীবনের সর্বস্তরের সার্থক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও ধীশক্তি অর্জনের লক্ষ্যে যে কর্মকা- পরিচালিত হয় তার সমষ্টির নাম; শুধু একটা নির্দিষ্ট কাজ বা কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকা- নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে যুবক ও বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া যাতে তারা যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী ঐতিহ্য ও ধ্যান-ধারণাগুলোকে বুঝতে পারেন এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার এই কার্যক্রমের মধ্যে তাদের নিজস্ব ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক আইন অধ্যয়ন প্রভৃতি যেমন অন্তর্ভুক্ত তেমনি শিক্ষার মৌলিক বিষয়াবলী যেমন ভাষার ব্যুৎপত্তি, ব্যক্তিগত উন্নয়ন, সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক পত্র যোগাযোগে দক্ষতা অর্জনও রয়েছে।

বৃটিশ ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস কমিশনের এই সংজ্ঞাকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে দুনিয়ার অধিকাংশ উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি জাতি স্বাধীন জাতি হিসেবে তাদের কৃষ্টি-কালচার শেখার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কি করছি? আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যদি তার নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ হন তাহলে এর দায় কে নেবে? জাতি, শিক্ষাব্যবস্থা, না বিশ্ববিদ্যালয়?

যখন শুনি তারা বা তাদের কেউ কেউ গুগল থেকে তরজমা করে পাঠ্যপুস্তক লেখেন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়।
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস এবং উপাদান আধেয় নিয়ে সম্প্রতি সারা দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। শিক্ষক-অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন যে এ সব পাঠ্যপুস্তকে বিশেষ করে ৫ম থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত যে সব প্রবন্ধ নিবন্ধ, ছড়া কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয় বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট মুসলমানদের আদর্শ ঐতিহ্য, ধর্ম বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিরও পরিপন্থী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এই দেশে মানুষ সৃষ্টির ইতিহাসকে ছেলে মেয়েদের স্মৃতিপট থেকে মুছে দিয়ে সেখানে বিবর্তনবাদকে আপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনে মানুষকে বানর, হনুমান ও সিম্পাঞ্জির বংশধর হিসাবে পরিচিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে এবং বলা হচ্ছে যে কালের বিবর্তনে তারা আকৃতি পরিবর্তন করার প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে লেজ খসে-মানুষের বর্তমান অবয়ব গ্রহণ করেছে। দেশবাসীর প্রবল আপত্তির মুখে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি সম্প্রতি একটি সাফাইও গেয়েছেন। তিনি বলেছেন যে পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের থিওরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কোথাও বানর/সিম্পাঞ্জিকে মানুষের পূর্ব পুরুষ বলে অভিহিত করা হয়নি। তার এই অবস্থানের পেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কোমলমতি এই শিশু কিশোরদের বইতে ডারউইনের মতবাদ অন্তর্ভুক্ত করার যুক্তি কি? এটা কি তাদের মধ্যে নাস্তিক্যবাদ ঢোকানের লক্ষ্যে শ্লো পয়জন নয়? বইগুলোতে মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাফল্যকে বিকৃত ও খাটো করা হয়েছে। যে বর্ণভেদ প্রথা এবং সতিদাহ প্রথা, হিন্দু সমাজকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সেই বর্ণভেদ প্রথা নাকি মুসলিম শাসকরা প্রচলন করেছিলেন এবং নারী নির্যাতনের জন্য তারাই দায়ী। তাদের কথানুযায়ী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-হিন্দুদের এই বর্ণ প্রথাও নাকি মুসলমানদের অবদান! এই পুস্তকগুলোতে পর্দা প্রথাকেও অপমান করা হয়েছে। এখানে ইসলাম বিদ্বেষ, ইতিহাস বিকৃতি এবং যৌন বিকৃতিকে ও উৎসাহিত করা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মতিতে ছেলে মেয়েদের সংসর্গকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম মনীষীদের প্রবন্ধ নিবন্ধ ও শিক্ষামূলক গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে হিন্দু পুরানের গল্প ও হিন্দু লেখকদের মুসলিম বিদ্বেষমূলক প্রবন্ধ, গল্প কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমন কি রাসূল (দ:) এর বিদায় হজ্বের বক্তৃতাও বাদ দেয়া হয়েছে।

এই দেশে হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু এবং মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে। তাদের আচার আচরণ, খাদ্য প্রণালী ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা গোসল করেছি তারা স্নান করেছে। আমরা বদনা ব্যবহার করেছি তারা লোটা, পিতার বোনকে আমরা ফুফু, মায়ের বোনকে খালা, ভাইয়ের বউকে ভাবী, মায়ের মাকে নানী, পিতার মাকে দাদী ডাকছি, বোনের স্বামীকে আমরা ভাইসাব বা দুলাভাই বলি। এখন এই বই পত্রের অনুশীলনে আমাদের ছেলে-মেয়েদের কালচার পরিবর্তন করে মাসি, পিসি, ঠাকুর দা, ঠাকুর দি, দিধা, ঠাকুর মা, জামাই বাবু প্রভৃতি শিখানো হচ্ছে। মুসলিম সমাজ এগুলো গ্রহণ করতে পারছে না।

আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অনেক শীর্ষনেতা বলে থাকেন যে ১৯৭১ সালে অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্যই তারা স্বাধীনতা এনেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অর্থ কি ধর্মহীন বাংলাদেশ? অনেকে ধর্মকে সম্প্রদায় বলে। যেমন মুসলিম সম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায়, খৃষ্টান সম্প্রদায়। বিভিন্ন ধর্মানুসারীদের মধ্যে যখন সংঘাত বাধে তখন তাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে। তাহলে বাংলাদেশকে ধর্মহীন করার জন্যই কি শিক্ষা ক্ষেত্রে এই কসরৎ চলছে? এই সিলেবাস ও তার contents যারা তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা নগণ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সিনিয়র অফিসারদের প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিছু দিন আগে টাঙ্গাইলের একটি মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে একজন হিন্দু শিক্ষককে সরকার নিয়োগ দিয়েছিলেন। দেশে এখন অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল আছে যেখানে হিন্দু শিক্ষক শিক্ষিকারা ইসলাম ধর্ম পড়ান। এর উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার নয়?

https://dailysangram.com/post/520486