২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:০৭

৪ মাসেও অভিযুক্ত সবার শাস্তি নিশ্চিত হয়নি

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পর প্রায় চার মাস হতে চললেও গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য অভিযুক্ত সবার শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। নির্দেশনার এক মাসের মধ্যে শাস্তি কার্যকর করে কমিশনকে জানানোর বিধান আছে। কিন্তু কার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কমিশন এখনো জানতে পারেনি।

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মে সম্পৃক্ততা এবং দায়িত্বে অবহেলার দায়ে গত ১ ডিসেম্বর রিটার্নিং অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের পাঁচজন উপপরিদর্শকসহ ১৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অভিযুক্তদের মধ্যে ১২৬ জন প্রিজাইডিং অফিসার। এর মধ্যে একজন প্রিজাইডিং অফিসারকে দুই মাসের জন্য বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।

এ ছাড়া অনিয়ম হওয়া ১৪৫ নির্বাচনী কেন্দ্রের পোলিং এজেন্টরা ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। তবে অনিয়ম থেকে দায়মুক্তি পান সরকারদলীয় প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন, জেলা প্রশাসক মো. ওলিউর রহমান এবং তখনকার জেলা পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম। পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাহমুদ হাসান রিপন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর বিধান ৯১-ই ধারায় যাঁর পক্ষে অনিয়ম হয়েছে, সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। তবে গাইবান্ধা-৫ আসনের বেলায় কমিশন তা প্রয়োগ করেনি।

প্রায় চার মাস পার হতে চলেছে; তবু কেন ইসির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি, জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রায় ৫০ জনের বিষয়ে ফিডব্যাক (পদক্ষেপ নেওয়া) পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আবার কারো কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনের কপি চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।’

নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এ এ ক্ষেত্রে এক মাসের সময় নির্দিষ্ট করা আছে। স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন অফিস থেকে বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া ও তাঁদের জবাব পাওয়ার পর তাঁরা দোষী না নির্দোষ, তা নির্ধারণ করা হবে। অভিযুক্তদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজগুলো করছে।

একাধিক সূত্র জানায়, ওই নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে এখন নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে আছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এখনো গাইবান্ধায় কর্মরত আছেন। অন্য অভিযুক্তদের কেউ কেউ বদলি হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তে কী পাওয়া গেছে, তা স্থানীয় নির্বাচন অফিস ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। বরং অনেকে তাঁদের বদলিকে স্বাভাবিক বদলি হিসেবে দেখছেন।

গাইবান্ধা নির্বাচন অফিস সূত্র জানায়, তারা শুধু ১২৫ জন প্রিজাইডিং অফিসারের ব্যাপারে আংশিকভাবে ওয়াকিবহাল। অন্যদের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারদের মধ্যে কয়েকজনের ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়োগকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে তার এবং সে নোটিশের জবাবের অনুলিপি আছে। জেলা প্রশাসনের কাছেও আছে একই অনুলিপি।

এ তথ্যগুলো জেলার ফুলছড়ি উপজেলার। অনেক চেষ্টা করেও সাঘাটা উপজেলার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
জেলা নির্বাচন অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফুলছড়ির বুড়াইল মডেল স্কুল ও কলেজের প্রভাষক ওয়াহেদুজ্জামান প্রধান কঞ্চিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন। একই কলেজের শাহ মোহাম্মদ শাহান ছিলেন রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এবং মো. মোর্শেদ আলম চর কাবিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন। তাঁদের বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্ত করে গত ২২ থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান। সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী, ‘অসদাচরণ’-এর দায়ে তাঁদের কেন পরবর্তী দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হবে না, তা সাত দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়। তাঁদের শুনানিতেও ডাকা হয়। নোটিশের জবাব দিয়ে তাঁরা নিজেদের ‘নির্দোষ’ দাবি করেছেন।

একই উপজেলার উদাখালী আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পাগলার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার ননী গোপালকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন ওই স্কুলের সভাপতি নুতন কুমার দাস। ননী গোপাল তাঁর কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে জবাব দেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি ‘প্রমাণাদির অভাবে’ তাঁকে অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এসব অভিযোগ প্রমাণের জন্য আরো অন্তত এক মাস সময় প্রয়োজন। নিয়ম অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, নির্বাচন অফিসসহ নির্ধারিত অফিসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে তথ্য আদান-প্রদানের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দু-তিন জায়গায় অনুলিপি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন।

ফুলছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, কারণ দর্শানোর নোটিশের পর ফের তদন্তসহ বেশ কিছু ধাপ রয়েছে। শুনানিও অনুষ্ঠিত হবে। তিনি শুনানিও করেছেন। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আবদুল মোতালিব বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। ‘নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-৯১’ অনুযায়ী অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যাপারটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে।

গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তাতে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল নির্বাচন কমিশন। বিভিন্ন কেন্দ্রে নানা অনিয়ম ধরা পড়ায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার চার ঘণ্টার মাথায় ১৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫১টি ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় কমিশন। শেষমেশ ভোট শেষের দেড় ঘণ্টা আগেই ওই উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনিয়ম তদন্তে গত ১৩ অক্টোবরে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। গত ২৭ অক্টোবর কমিটি ৫১ কেন্দ্রের অনিয়ম তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ইসি। ফলে প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ৫ নভেম্বর পুরো নির্বাচনে অনিয়ম তদন্তের নির্দেশ দেন সিইসি। মধ্য নভেম্বর কমিটি কমিশনের কাছে এক হাজার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে নির্দেশ পাঠায় কমিশন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/25/1264459