২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৪০

রমযানে ব্যবসায়ীদের কাছে প্রত্যাশা

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন

কয়েক বছর আগে এক মুরগি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অভিনব ব্যবসা পদ্ধতির কথা শুনেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম রমযান মাসে মুরগির ব্যবসা করেন মিথ্যা কথা বলতে হয় না। উত্তরে বললেন বুদ্ধি থাকলে মিথ্যা কথা বলতে হয় না। জিজ্ঞেস করলাম এটা কীভাবে? তিনি বললেন আমি কাওরান বাজার থেকে মুরগি কিনে বাসায় আমার স্ত্রীর কাছে কেনা দামের চেয়ে বেশি দামে মুরগি বিক্রি করি। তারপর বিকাল বেলা যখন বাজারে যায় তখন স্ত্রীর কাছ থেকে বেশি দামে মুরগি কিনে বাজারে বিক্রি করি। কেউ যখন আমাকে মুরগির দাম জিজ্ঞেস করে তখন স্ত্রীর কাছ থেকে কেনা দামের কথা বলি। এতো গেল মুরগির কথা। কাপড় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও জুয়াচুরি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে রমযান মাস যখন আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়। ঈদের সময় বেশি লাভের আশায় কিছু ব্যবসায়ী মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তারা আল্লাহ কসম খেয়ে বলেন- এই কাপড়ের ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; নতুবা আমার লস হবে। আপনাকে একেবারে কেনা দামে দিয়ে দিচ্ছি। অথচ মিথ্যা শপথের মাধ্যমে ব্যবসা করা জঘন্য পাপ। পাপ জানা সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী লোভের বশবর্তী হয়ে হালাল ব্যবসাকে হারামে পরিণত করছে। অথচ রমযানকে সওয়াব অর্জনের মওসুম বলা হয়। রমযানে ইবাদতের সওয়াব অন্য সময়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এ মাসে রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়। (মুসলিম: ১০৭৯) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘‘রমযানে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল। (শুআবুল ইমান: ৩/৩০৫-৩০৬)
সারাবিশে^ অনাবিল ভ্রাতৃত্ব আর ভালোবাসার বন্ধন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার মাস রমযান। দুঃখ, ব্যথা, কষ্ট ও বেদনা ভাগাভাগি করার মাস রমযান, সংযম ও সবরের মাস রমযান। রমযান আমাদের ভালো ও মন্দের পার্থক্য শেখায়। কিন্তু আমরা ইসলামের বিপরীত কাজ করি। একথা ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রমযান ব্যবসায়ীদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ অর্জন করার মওসুম। তারা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির অংশীদার হতে পারে। রমযানের কল্যাণময়তা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পারলে অসহায় গরীব মানুষ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ উপকৃত হতো। ব্যবসায়ের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই, বিরোধ অনৈতিকতা নিয়ে। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার প্রয়াসে ব্যবসায়ের বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতারণা, ভেজাল, ওজনে ও মাপে কম দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সুরা মুতাফফিফিনে আল্লাহ বলেন, মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। (সূরা মতাফফিফিন, আয়াত-১-৩) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন ‘‘তোমরা সঠিক ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না।’’ (সূরা রহমান,আয়াত : ৭-৯)।

ভেজাল কিছুতে পিছু ছাড়ছে না। রমযানে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ভেজাল ও মানহীন পণ্যের হাট সর্বত্র বিরাজ করলেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ইফতারির আইটেম থেকে শুরু করে সাহরির দুধ-কলা পর্যন্ত ভেজালে ভরপুর। ওষুধে ভেজাল, খাদ্যে ভেজাল, ফলে ভেজাল, তরিতরকারিতে ভেজাল। এককথায় সর্বত্র ভেজালের ছড়াছড়ি। মিষ্টিতে কাপড়ের রঙ মেশানো হয়, আপেল, কমলা, আঙ্গুর, খেজুর, বেদানা, নাশপাতি, পাকা পেঁপে, আনারস ও তরমুজে রাইপেন নামের বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়। শাসসবজি গাছে থাকতেই রাসায়নিক প্রয়োগ করা, হোটেল রেস্তোরায় মৃত পশুর গোশত বিক্রির খবর এখন আর কাউকে আলোড়িত করে না। তবে মাঝে মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানের খবর মুদ্রিত হয়, ওই পর্যন্ত শেষ! তারপর আবার পূর্বের অবস্থা ফিরে আসে। অর্থাৎ ইঁদুর বিড়াল খেলা হয়। কিন্তু জেনেশুনে বিষপান করা বন্ধ হয় না।

বিশে^র অনেক মুসলিম দেশে রমযান মাসে পণ্যমূলের ছাড়ের হিড়িক পড়ে, সেখানে আমাদের দেশে ছাড়ের হিড়িক তো দূরের কথা উল্টো ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। পণ্যদ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী হয় যা ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত রমযান মাস উপলক্ষে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কর্মঘণ্টা কমানোর ঘোষণা, অফিসের কাজ বাসায় করার সুযোগ এবং দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটির অনেক ব্যবসায়ী কয়েক হাজার পণ্যে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়ার ঘোষণা করেছে। অথচ আমাদের দেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কৃত্রিম সংকট না থাকলেও সংকট তৈরি করা হয়। রমযান মাসে তারা সর্বোচ্চ মুনাফার করে। তাদের কাছে অসহায় দরিদ্র মানুষের আর্তনাদ কেবল কতগুলো ঠুনকো শব্দ মাত্র! ব্যবসায় সততা অবলম্বনে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসটি স্মরণ করা যেতে পারে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ^াসী ব্যবসায়ী ব্যক্তি হাশরের দিন নবী সিদ্দিক ও শহীদদের কাতারে থাকবেন। (তিরমিজি-হাদীস নং ১২০৯) অন্য এক হাদীসে এসেছে,হযরত জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত-আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন যে ন¤্রতার সাথে ক্রয়-বিক্রয় করে ও পাওনা ফিরিয়ে চায়। (সহীহ বুখারি, হাদিস নং-২০৭৬)

ইসলাম ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে নয়; বরং ইসলাম ব্যবসাকে উৎসাহিত করে। যে ব্যক্তি সৎ ব্যবসা করে এবং হালাল অর্থ উপার্জন করে আল্লাহ তায়ালা তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেন। আর সৎ ব্যবসার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি শুধু নিজেই ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকে তা কিন্তু নয়; বরং নিজ পরিবার-পরিজনও হারাম খাদ্য ও বস্তু গ্রহণ করা থেকে রক্ষা পায়। ব্যবসায় ইনসাফ ও সততা থাকলে আল্লাহতায়ালার রহমত ও কল্যাণ পাওয়া যায়। কিন্তু যে ব্যবসায় ধোঁকাবাজি করা হয় সেখানে আল্লাহর রহমত থাকে না। অথচ কিছু মানুষ ধোঁকাবাজির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে পকেট ভারী করে। নকল পণ্য বিক্রি করে আসল পণ্যের দাম হাকিয়ে নেয়। ভালো পণ্যের সাথে ক্রটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেয়। এই প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। রমযান আসলেই কেন পণ্যের দাম বাড়ে তা সংশ্লিষ্ট মহলের খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। এমনিতে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ বাজার কমিয়ে দিয়েছে। চাল, ডাল, চিনি, ডিম, মুরগি, গোশত, আটা, সবজিসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম রকেট গতিতে বাড়ছে তো বাড়ছেই। ধরা ও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। শুধু দূর থেকে দেখা যায়। ফলে সাধারণ মানুষের বোবা কান্নার আওয়াজ ইথারে ইথারে ভাসছে। কিন্তু মুনাফাখোরদের মন টলেনি। অনেকে চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় বাজার না করেই বাসায় ফিরছে। ব্যয়সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে। নদীর নয়, পুকুরের পাঙ্গাস মাছ যারা খেত না এখন তাদের কাছে পুকুরের পাঙ্গাস মাছ সোনার হরিণ। বয়লার মুরগি যারা খেত না তাদের খাবারের তালিকায় এখন বয়লার মুরগি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ডিম ও বয়লার মুরগির দাম বাড়ার কারণে তাও কিনতে দশবার ভাবতে হচ্ছে। এ অবস্থার আশু অবসান কাম্য!

রমযান তাকওয়া ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। সে জন্য একজন রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জনমানবহীন নির্জন নিরালা জায়গায় রমযানের বিপরীত কোন কাজ করে না। অথচ কেউ কেউ রমজান মাসে ব্যবসায় মিথ্যার বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়, মানুষের ওপর জুলুম করে। খাদ্যে ভেজাল মেশান, ওজনে কম দেন, এক নম্বর জিনিস বলে দুই বা তিন নম্বর জিনিস বলে চালিয়ে দেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেন। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন-‘যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ রোজার মাসে মুনাফা অর্জন করা যাবে না এমন কোন কথা নেই। কিন্তু দেশের মানুষদের জিম্মি করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করা মোটেও ব্যবসায়ের নীতি হতে পারে না। পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে ভালো বলে চালিয়ে দেয়া জঘন্য প্রতারণা। প্রতারণার ব্যাপারে রাসূল (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ-২২৪৭)

প্রাসঙ্গিকক্রমে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ব্যবসায়ের সততার এক উজ্জ¦ল দৃষ্টান্তের নমুনা তুলে ধরে লেখার সমাপ্তি টানবো। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একবার তার ব্যবসায় কাজে নিয়োজিত সহযোগীকে পণ্য বিক্রির জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, যেসব পণ্য ত্রুটিপূর্ণ সেগুলো যেন ক্রেতাদের দৃষ্টিগোচরে এনে বিক্রি করা হয়। কিন্তু ইমামের এই নির্দেশনা সহযোগী ভুলে সমস্ত পণ্যই বিক্রি করে দেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বিক্রিত পণ্যের সমুদয় টাকা (৩৫০০০ দিরহাম) দান করে দেন। এমনকি তার কাছে কোনো বিক্রেতা অজ্ঞতাবশত বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে কোনো পণ্য বিক্রি করতে আসলে তিনি তাদেরকে সঠিক মূল্য অবহিত করে সেই মূল্যেই পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতেন। আমাদের ব্যবসায়ীদের রমযানের তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হয়ে ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাকওয়া পালন করার খোশ নসিব যেন দান করেন।

https://dailysangram.com/post/520225