২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৭:০৬

ভারতীয় কূটনীতি ও ভূরাজনীতি

|| সোলায়মান আহসান ||

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফর নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। প্রধান বিরোধী দল বলছে, ‘কেবলই দেয়ার এবং কোনো কিছুই না পাওয়া’ সফর। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কিছু চাইতে যাইনি, শুধু বন্ধুত্ব চাইতে গেছি এবং সেটা পেয়েছি।’ এতসব কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি মুখ্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে তা হলো, প্রতিরক্ষাবিষয়ক সমঝোতা এবং তিস্তার পানিবণ্টনে সুরাহা না হওয়া। তিস্তা নিয়ে দিল্লি আবারো কোন রাজনীতি খেলছে, বিষয়টি বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলছে।
আজকের ভারতে ক্ষমতার মগডালে উঠে এসেছে হিন্দু উগ্রবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। উগ্রপন্থী আরএসএসের এককালের তুখোড় নেতা, পরবর্তীকালে গুজরাট ট্র্যাজেডির খলনায়ক দামোদর দাস মোদি সাম্প্রদায়িকতার সিঁড়ি দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন।
১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে বিজেপি মাত্র দু’টি আসন পায়, সেই বিজেপি ১৯৮৯ সালে ৮৬টি, ১৯৯১ সালে ১২০ এবং এরপর ১৯৯৬ সালে ১৬১টি পেয়ে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। আর ২০১৪ সালে তো দলটি মোদির নেতৃত্বে ক্ষমতার শীর্ষে। বিজেপি এই উত্থানের পেছনে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষকেই রাজনীতির প্রধান উপজীব্য করে তোলে। এবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সেই রাজনীতির খুঁটি হিসেবে দিল্লির শাসকগোষ্ঠী ভালোভাবে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে কি?
নানা কারণে মমতার ওপর বিজেপি ুব্ধ। সম্প্রতি নোট বাতিলের বিরুদ্ধে মমতা সোচ্চার ভূমিকা নিয়েছিলেন। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সুরক্ষিত দুর্গ মমতা যেভাবে পাহারা দিয়ে আসছেন, বিজেপি তাতে তেমন ঢুকতে পারছে না। সেই ক্ষোভের উদগিরণ দেখা গেল একজন বিজেপি যুব নেতার মুখে। ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার নেতা যোগেশ ভারশান মমতার মাথার বিনিময়ে ১১ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। মমতা নাকি কিছুটা মুসলিম-ঘেঁষা অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের। ইফতার পার্টিতেও যোগ দেন। এসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তাই বলে প্রকাশ্যে মাথা দাবি অর্থের বিনিময়ে? এটা যদি বিজেপির রাজনীতি হয়, তবে ভারতের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর বিপদ। কারণ হিংসা কেবল প্রতিহিংসাই ডেকে আনে।
শেখ হাসিনার এবারকার দিল্লি সফরের উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ ছিল ‘মমতা’। মমতাকে দিল্লিতে তলব। ভারতের রাষ্ট্রপতির ভবনে অবস্থানরত শেখ হাসিনার সাথে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও বৈঠকে তার উপস্থিতি। মমতাকে বাংলাদেশের পক্ষে নমনীয় করার নাকি প্রয়াস চলেছিল। মোদির দেয়া প্রীতিভোজে ডেকে মমতা-হাসিনা সমঝোতার প্রয়াসের কথা প্রচার করা হয়েছে।
‘বন্ধুত্ব’ পরীক্ষায় হাসিনা কি হেরেছেন? নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ জিতেছেন। মমতা হয়তো ভাবছেন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে তিনি জিতে গেছেন। পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার তাকে দিয়ে তিস্তার চুক্তিতে সাক্ষীগোপাল বানাতে। মোদি ভাবছেন, কংগ্রেস সরকারের মতো এ আমলেও মমতাকে ‘নন্দঘোষ’ বানিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার চুক্তি করা থেকে বিরত রাখা গেছে। এতে বাংলাদেশের বাঙালিদের মনে ধাক্কা লাগবে, পশ্চিম বাংলার মুসলিম বাঙালির সমর্থনও খানিকটা হারাতে পারেন মমতা। তাহলে, পশ্চিমবঙ্গে আগামীতে বিজেপির পথ প্রশস্ত হতে পারে।
শেখ হাসিনা ভাবতে পারেন, ইলিশ-রসগোল্লা দিয়েও মন জয় করা গেল না; তখন আর কী করাÑ এবার ‘অন্য পথে’ হাঁটতে হবে। সে পথটি কী, সেটা নিয়ে তিনি হয়তো ভাবছেন। এর আগে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফরে আসনে ২০১৫-এর জুনে। সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এটা ফিরতি সফর বলা যায়। তবে এই সফরের আগে কিছু আপসপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা তাৎপর্যমণ্ডিত বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
এক. গত বছর অক্টোবরে সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ আসেন। প্রেসিডেন্টের ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীর মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক স্টেট কাউন্সিলের সদস্য, পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যমন্ত্রী। চীনের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ১০০ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এসেছিলেন প্রেসিডেন্টের সাথে। সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। কিছু প্রকল্প এবং পরিকল্পের ব্যাপারে আরো বিনিয়োগের আশ্বাস মেলে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের ৪৫ বছরে এটাই কোনো দেশের সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি। বলা যায়, এর আগে প্রাপ্ত সমুদয় ঋণসহায়তা ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য দু’বারে ঋণ প্রতিশ্রুতি পাঁচ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তাও নমনীয় শর্ত না হওয়ায় ঋণপ্রতিশ্রুতির অর্থ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি।
দুই. সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীন থেকে আনা সাবমেরিন ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গত ১২ মার্চ সাবমেরিন দু’টি নৌবাহিনীতে কমিশনিং করা হয়। এগুলো টর্পেডো ও মাইনে সজ্জিত অত্যাধুনিক সাবমেরিন। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকেও সমুদ্রসম্পদ রক্ষা এবং চোরাচালান, মানবপাচার ইত্যাদি প্রতিরোধে কার্যকর হবে এই সাবমেরিন।
ভারত কিন্তু এটাকে সুনজরে দেখছে না। প্রকাশ্যেই সাবমেরিনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এক টিভি টকশোতে ভারতের নৌবাহিনীর একজন সাবেক কমোডর, একজন সাবেক সচিব ও কূটনীতিক এবং বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেই ফেললেন, বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে সাবমেরিনের কী প্রয়োজন? কার সাথে যুদ্ধ করবে? তা ছাড়া বাংলাদেশের যেটুকু সমুদ্রসীমা, তা পাহারা দিতে সাবমেরিনের প্রয়োজন কী? এসব অদ্ভুত কথা। একটা দেশ যত ছোটই হোক তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কথা বিবেচনা করে দুটো সাবমেরিন ক্রয় করল, তা কেন ভুল হবে?
সম্প্রতি চীন বাংলাদেশে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে, সে অর্থের নিরাপত্তার স্বার্থে যদি প্রতিরক্ষার বিষয়টি আসে, সেটা দোষের কী?
পাকিস্তানে বেলুচিস্তানের গোয়াদরে গভীর সমুদ্রবন্দর ও গোয়াদর মেগাসিটি প্রকল্প এবং ‘‘One belt one way’- -এর আলোকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৫৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সচেষ্ট রয়েছে চীন। এসব মেগা প্রকল্পের নিরাপত্তার স্বার্থে চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তুলছে। একইভাবে শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রে হামবানটেটা বন্দর ও মেগা সিটি প্রকল্পে চীন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। শোনা যায়, এ বন্দরে চীনের ছয়টি সাবমেরিনও অবস্থান করে থাকে। হয়তো নিরাপত্তার স্বার্থে।
তিন. শেখ হাসিনার এবার দিল্লি সফরের তারিখ বারবার বিলম্বিত হচ্ছিল। এ ছাড়াও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব এবং সফরের আগমুহূর্তে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধানের বাংলাদেশ সফরের ঘটনা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এ ছাড়া ১২ মার্চের ঢাকায় এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যেভাবে বললেন তাও ভাবিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী কোনো কথাই উদ্দেশ্য ছাড়া এবং ভিত্তিহীনভাবে বলতে পারেন নাÑ এটাই সাধারণ্যে বিশ্বাস।
দিল্লি থেকে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছে; যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, দিল্লি গিয়েছিলেন ‘কিছু পেতে নয়, বন্ধুত্ব অর্জন করতে।’ তিনি জানতেন, তিস্তার বিষয়ে কিছু এবার হবে না। ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করিয়ে নেয়া। সেটা পারেনি বলেই তিস্তার পানিও গড়ায়নি। প্রতিরক্ষা সমঝোতা যা হয়েছে তা-ও বাংলাদেশের জন্য হজম করা কতটুকু সম্ভব, তা ভেবে দেখতে হবে।
সফরের আগে ভারতের তৎপরতায় বোঝা যাচ্ছিল, তিস্তার বিষয়ে তাদের তেমন মনোযোগ নেই। প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের মিডিয়াই বরং সামনে আনে। তাই মুখ রক্ষার জন্য মমতাকে দিল্লিতে ডেকে একটা সাজানো ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করা হয়। শেখ হাসিনাও মুখরক্ষার জন্যই মোদিকে শেষতক ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ চুক্তি সইয়ের অনুরোধ জানান। মোদি মৃদু হেসে অপারগতা জানান। শেখ হাসিনা বুঝে গেছেন ইলিশ-রসগোল্লায় মন নরম হলো না, বন্ধুত্ব পাওয়া গেল, যদিও ‘ভেটকি মাছের পাতুড়ি আর চিতল পেটির মুইঠ্যা’তে। ভূরাজনীতির বিষয়টিও বুঝে গেছেন। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ঢাকা আসছেন। কারণ রাশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া যেকোনো স্থান লুফে নিতে ব্যস্ত। মেরুকরণের পাল্লা ভারী করতে মুসলিম অনেক দেশের সাথে রাশিয়ার সখ্য দৃশ্যমান। রাশিয়ার সাথে স্বাক্ষর হতে পারে প্রতিরক্ষা সমঝোতা। প্রধানমন্ত্রী এমন ইঙ্গিত দিল্লি থেকে এসে সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন। ভূরাজনীতির এই খেলায় বাংলাদেশ ভালোভাবে পা রেখেছে কি? এ ব্যাপারে আমরা কতটুকু সক্ষম ও পটু, তা আগামীতে প্রমাণিত হবে। সামনে কিন্তু মেরুকরণের খেলা আরো আছে। ট্রাম্প ইউটার্ন করছেন। রাশিয়ার পুতিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফগানিস্তানের দিকে নজর ফেলেছেন। তাই বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে উচিত হবে কি এমন ভূরাজনীতির খেলায় এখনই নেমে পড়া?

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/213717