২৪ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৫:৩২

বৃষ্টিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। এতে অনেক স্থানে জমতে শুরু করেছে স্বচ্ছ পানি। জমে থাকা এই স্বচ্ছ পানি থেকে ফের এডিস মশার প্রকোপ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে এই এডিস মশা দমনে আগাম ব্যবস্থা না নিলে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোলরুমের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গতকাল ২৩ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮১৯ জন রোগী। এদের মধ্যে মারা গেছে ৯ জন। রাজধানীতে ছয়জন আর চট্টগ্রামে তিনজন। আগের বছর এই সময়ে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১৫৫ জন। তবে কেউ মারা যায়নি। একইভাবে একই সময়ে ২০২১ সালেও কেউ মারা যায়নি। ফলে এবার ডেঙ্গু নিয়ে বাড়তি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, সামনের দিনগুলোতে আরো হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। এই বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশার বিস্তার বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, এডিস মশার ডিম ছয় মাস শুকনো স্থানে থাকলেও বেঁচে থাকতে পারে। যদি মুষলধারে বৃষ্টি হয়, তাহলে এডিসের লার্ভা ধুয়েমুছে যায়। আর থেমে থেমে বৃষ্টি হলে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্মায়। কয়েক দিন ধরে যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে বিভিন্ন পাত্রে স্বচ্ছ পানি জমেছে। কেউ কেউ কোথাও কোথাও এই জমে থাকা পানি অপসারণ করলেও অনেক স্থানে এখনো জমে থাকা পানি অপসারণ করা যায়নি। ফলে জমে থাকা ওই পানিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বছর ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন যত বৃষ্টি হবে, এডিস মশার বিস্তার তত বেশি হবে। এর মধ্যে কিছু মশা ভাইরাস বহন করে, যে মশার কামড়ে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর ডেন-১, ডেন-৩—সব ধরনের রোগী পাওয়া গেছে। ওই ভাইরাস বহনকারী মশা রয়ে গেছে। অর্থাৎ ডেন-১ বা ডেন-৩ দ্বারা যে গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল, এবার অন্য কোনো সেরুটাইপ দ্বারা সে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম হলো ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। সে হিসেবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। তবে এবার বেশ আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর ধরন সেরুটাইপ

ডেন-৩ বেশি ছিল। যারা ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তারা যদি আবার একই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে ডেঙ্গু বাড়বে না। তবে গত বছর যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি, এ বছর তারা যদি ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হয় বা নতুন কোনো ধরন দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে ডেঙ্গু বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে আমাদের দেশে সেরুসার্ভেইল্যান্স হচ্ছে। বর্তমানে নতুন সেরুটাইপ রয়েছে কি না বা কোন এলাকায় কোন সেরুটাইপ রয়েছে সেটি জানা দরকার। আমাদের দেশে লোকসংখ্যা প্রচুর। ফলে ডেঙ্গু বাড়বে, এটা বলা যায়।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন কিউলেক্স মশার মৌসুম শেষ আর এডিস মশার মৌসুম শুরু। যেহেতু মাঝেমধ্যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাই এখন থেকেই প্রকোপটা শুরু হবে। এর জন্য আমাদের বিশেষ অভিযান চলছে। এই অভিযান ১৯ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের দিকে বেশি জোর দিয়েছি। কমিয়ে দিয়েছি ফগিং। একই সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ঘণ্টা বাজিয়ে এলাকাবাসীকে সতর্ক করছি। নির্মীয়মাণ ভবনগুলো নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। যেসব ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, সেখানে লার্ভা জন্মেছে কি না তা দেখার জন্য মালিককে নোটিশ দিচ্ছি। নোটিশে কাজ না হলে মামলা করা হচ্ছে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে। তদারকি করা হচ্ছে কোথাও যেন পানি জমতে না পারে। এ জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আশা করছি, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যতই হাসপাতাল বানাই, শয্যা বাড়াই, কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আমরা কত রোগীর চিকিৎসা করব?’

প্রতিরোধের উপায় : ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, শুরুতে প্রয়োজন এডিস মশা জন্মানোর স্থান বন্ধ করা। এটা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। এর জন্য নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি ভবনে একজনের ডেঙ্গু হওয়া মানে বাকিরা ঝুঁকিতে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ছাদবাগান করব তখন, যখন নিজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নিতে পারব। না পারলে ছাদবাগান করা বন্ধ করতে হবে। বাসায় টবে অবশ্যই ফুলের গাছ রাখব। তবে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে না পারলে দরকার নেই। বাসার পানির ট্যাংকের নিচে ফাঁকা জায়গায় জমে থাকা পানি নিজ দায়িত্বে অপসারণ করতে হবে। স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের দুই দিন করে দায়িত্ব বণ্টন করা হলে ওরা বাসার বিভিন্ন প্রান্তে জমে থাকা জুস, চিপসের প্যাকেট পরিষ্কার করবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/24/1264182