২৪ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৫:২৭

মানিকগঞ্জে নিম্নআয়ের মানুষের দিনকাল

‘ব্রয়লার মুরগির মাংসের কথা বইলেন না, আইজ দুই-আড়াই মাস ধরে মাংসের ধারেকাছে যাইবার সাহস পাই না। মাংসের বাজারে আগুন লেগেছে। তেল কিনুম না মাছ কিনুম, চাইল কিনুম না, আটা কিনুম, কোনো কিছুতে হাত দেয়া যায় না। আটার দামও ৭০ ট্যাকা কেজি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বৌ-পোলাপান নিয়ে কীভাবে বাঁচুম জানি না। কামলা দেই কিন্তু মজুরি কম। ৫ জনের সংসারে একা খাটি, খুব কষ্টে আছি, দেখার কেউ নেই।’ কথাগুলো বলছিলেন শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের ইটভাঙ্গা শ্রমিক ফজল মিয়া।

বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের বানিয়াজুরী ক্রসব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল সড়কের রাস্তা প্রশস্তকরণে ইটভাঙ্গার কাজ করছেন শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের হতদরিদ্র কয়েকজন শ্রমিক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলতেই ওই গ্রামের ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিক বেসামাল বাজার নিয়ে অসহায় জীবনযাত্রার কথা তুলে ধরেন মানবজমিনের কাছে। তাদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ।

এরা সবাই শরীরের ঘাম ঝরিয়ে যে অর্থ পান তা দিয়ে দিন শেষে চাল, ডাল, তেল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরেন। তাদের ভাষ্যমতে, আগে সপ্তাহে একদিন হলেও পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া মাছ আর ব্রয়লার মুরগির স্বাদ নিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে মাছ-মাংসের বাজার চড়া থাকায় তার ধারেকাছে যাওয়ারও সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। এ ছাড়া দুই বেলা ভাত খাওয়ার পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষের অন্যতম খাবার ছিল আটার রুটি। কিন্তু আটার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তারা রুটিও খেতে পারছেন না। সব মিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম ক্রমেই ভাবিয়ে তুলেছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে। আবার অসংখ্য পরিবার রয়েছে যারা রীতিমতো কষ্টে দিনাতিপাত করছেন কিন্তু আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে বাইরে প্রকাশ করতে পারছেন না। শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের মো. ইউসুফ আলি জানালেন, সারাদিন ইট ভেঙে সাড়ে ৪শ’ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে দুই কেজি চাইল, আলু, এক পোয়া তেল ও ডাইল কিনি। দামের কারণে মাছ-মাংস তো কিনবারই পারি না। তাই বেশির ভাগ সময় ডাইল, শাক সবজি দিয়েই ভাত খেতে অয়। দুই ছেলের একজন ১০ম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। জিনিসপত্র আগুন দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একা কামাই করে সংসার ও ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে কী যে কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না। এই গ্রামের মো. নাসির উদ্দিন জানালেন, নিজের শরীরের ঘাম ঝরিয়ে একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসানকে লেখাপড়া করাচ্ছি। সে বিএ পড়ছে। আগে ইট ভেঙে যা আয় হতো তা দিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কোনোরকম সংসার চালাতে পারতাম। কিন্তু এখন বাজারে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক সময় ছেলের কলেজে যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারি না। ভালো মন্দ খাওয়াইতে পারি না। ইচ্ছা থাকলেও মাছ- মাংসের ধারেকাছেও যেতে পারি না। যে পাঙ্গাশ মাছ ১১০ থেকে ১২০ টাকা ছিল এখন ২০০ টাকা কেজি, ব্রয়লার মুরগি ১৪০ টাকার জায়গায় এখন ২৬০ টাকা কেজি। আমাগো মতো কম টাকা আয়ের মানুষগুলোর টাকা দিয়ে মাছ মাংস খাওয়ার কোনো কায়দাই এখন নেই। তাই ডাল, ভাত, আলুসিদ্ধ এবং মাঝে মধ্যে ডিম খাই। আবার ডিমের দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে একমাত্র আল্লাহ মাবুদই জানেন। রফিক মিয়া জানালেন, এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়েছি। বছর ভরে সেই লোনের কিস্তি সারতে গিয়েই জীবন যায় যায় অবস্থা। দুই ছেলে ফরিদ ও মান্নান হাই স্কুলে পড়ে, ঘরে বৃদ্ধ মা-বাবা এবং স্ত্রী রয়েছে। কাজ থাকলে দিনে ৫শ’ টাকা রোজগার হয়। বর্তমান জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৬ জনের সংসারের ভরণপোষণ করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দু’বেলা ঠিকমতো খাবার জোগাড় করা আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই এলাকার লাল মিয়া জানালেন, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ ৬ জনের ভরণপোষণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। চাল, ডাল, তেল, আটাসহ যে জিনিসই কিনতে যাই দাম আগুন। মাংসের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় মাংস খাওয়ার কথা ভুলে গেছি। কপালে মাছ মাংস জুটছে না। এখন দুইবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে গেছে। বর্তমানে খুব কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। শুধু লাল মিয়া, রফিক মিয়া, নাসির উদ্দিন, ইউসুফ আলী ও ফজল মিয়াই নন তাদের মতো অসংখ্য খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষগুলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

https://mzamin.com/news.php?news=48132