২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৫

তুরাগ নদে দূষণের ২২৪ উৎস

ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানার পাইপ দিয়ে লাল-নীল-সবুজ কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্য অনবরত এসে পড়ছে নর্দমা বা খালে। সব মিলেমিশে পানি কুচকুচে কালো হয়ে নর্দমা বা খাল দিয়ে ফসলি জমি, নালা, ডোবা, জলাশয়, বিল প্লাবিত করে মিশছে নদ-নদীর পানিতে। পানিদূষণের এমন ভয়াবহ চিত্রের দেখা মিলবে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলজুড়ে।

বিষাক্ত বর্জ্যে এরই মধ্যে জেলার তুরাগ, চিলাই, বানার, পারুলী, শালদাহ ও বালু নদ মৃতপ্রায়। সেই সঙ্গে মোগরখাল, জানের খাল, সুকন্দিরবাগ, হায়দরাবাদ, লবঙ্গ, কেওয়াসহ শতাধিক খালের পানি কালো ও ভারী হয়ে এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। মরে গেছে সব জলজ প্রাণী।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন শুধু তুরাগ নদের টঙ্গী থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার অংশে ২২৪টি এবং চিলাইয়ে পানিদূষণের ৪৫টি উৎস চিহ্নিত করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে পাগাড়, আরিচপুর, মাছিমপুর, টঙ্গী বাজার, কামারপাড়া, রুস্তমপুর, ইছরকান্দি, কাশিমপুর, কড্ডা, মির্জাপুর, বোয়ালী, মকশ বিল, কালিয়াকৈর বাজার, দেশীপাড়া ও জয়দেবপুর এলাকায়।

গাজীপুর মহানগরীর পুবাইল হাড়িবাড়ীর টেক এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এ অ্যান্ড এ ট্রাউজার কারখানার তরল বর্জ্য রেলওয়ের ডোবায় গিয়ে মিশছে। সেখান থেকে কৃষিজমি, নালা ও পাশের জলাশয়, নাগদা খাল হয়ে মিশছে বালু নদে। কয়লার মতো কালো ওই পানি দিয়েই বোরোর জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষক।

স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ হোসেন জানান, কারখানায় ইটিপি থাকলেও ব্যবহার করা হয় না। তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় ডোবায়। পচা পানির দুর্গন্ধে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। ক্ষেতের ফসল, বিলের মাছ ধ্বংস হচ্ছে। ফসলের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকছে তরল বিষ।’

নগরীর কড্ডা, জরুন, ইসলামপুর, হোতাপাড়া, মাস্টারবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শত শত কারখানার বর্জ্য তুরাগে এসে মিশছে। ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের বড়বাড়ী সড়কে তুরাগ খাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, লাছমা সোয়েটার, বাংজিং ওয়াশিং, তাজ নিটিং, ফেন্সি গ্রুপসহ শতাধিক কারখানার পাইপ দিয়ে তরল বর্জ্য খালে পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম রফি বলেন, ‘কারখানার মালিকদের আগ্রাসনে খালের পানি আর পানি নেই। আলকাতরার মতো আর ভারী। পানি লাগলে শরীর চুলকায়, ঘা হয়ে যায়।’

জানা গেছে, টঙ্গী ও কোনাবাড়ী বিসিকসহ গাজীপুরে পাঁচ হাজারের বেশি কল-কারখানা আছে। এসব কারখানায় ইটিপি বাধ্যতামূলক হলেও অনেকে বন্ধ রাখছে। তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন তৎপরতা নেই।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার সাদত জানান, কারখানার বর্জ্যে গাজীপুরের নদী-খাল-বিলের পানি এখন দূষিত। দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন জানান, গাজীপুরের পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত হচ্ছে। এতে মানবদেহ ও জলচর প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দূষণে গাজীপুর সংকটাপন্ন হলে রাজধানী ঢাকাকেও বাঁচানো যাবে না। কারণ গাজীপুর হচ্ছে ঢাকার উজানের অঞ্চল।

পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া জানান, বহু প্রতিষ্ঠান ইটিপি চালু রাখে না। এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে প্রতি মাসেই ৫০-৬০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ ছাড়া দূষণের দায়ে গত কয়েক মাসে ১২টি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।


 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/23/1263836