২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৫১

কাজ পাচ্ছে শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উঠছে আজ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনায় অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দরপত্রে উল্লিখিত শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে ২১৭ কোটি টাকার (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ) সফটওয়্যার কেনার কাজ দেওয়া হচ্ছে। নানা কায়দাকানুনে অযোগ্যতাকে বৈধতা দিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। আজ ওই সফটওয়্যার কেনার প্রস্তাব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উঠছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে ৫২৯ কোটি টাকা এবং সরকারি খাতে ৫৫ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হবে।
এ প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল আমদানি-রপ্তানি আবেদন গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিকারকদের সেবা সহজ করা। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ ও সময় সাশ্রয় এবং পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস পাবে। এ লক্ষ্যে সরকারি একাধিক সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিও সম্পন্ন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দুই ধাপে অর্থব্যয় করার কথা। প্রথমত, সফটওয়্যার কেনায়। সফটওয়্যার কেনায় ২১৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। দ্বিতীয়ত, হার্ডওয়্যার (ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার) কেনা, পরামর্শক ফি, বিদেশে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার কেনার জন্য মনোনীত করা হয়। এগুলো হচ্ছে-দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েব ফন্টেইন গ্রুপ, সিঙ্গাপুরের ক্রিমসন লজিক, চায়নার প্রতিষ্ঠান ডেলয়েট কনসালটিং, নুকটেক এবং বাংলাদেশি সিএনএস। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিএনএসের স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) থাকায় সিএনএসকে বাদ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে নুকটেক চায়না ও ডেলয়েট কনসালটিং দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান ওয়েব ফন্টেইন ও ক্রিমসন লজিক প্রস্তাব জমা দেয়। এর মধ্যে দরপত্রের একাধিক অযোগ্যতাকে আমলে না নিয়ে ওয়েব ফন্টেইনের প্রস্তাব দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গ্রহণ করে। দরপত্রের ভলিউম-১-এর প্রাইস শিডিউলের ৩.৩ সেকশনে এবং অ্যাডেনডাম-১-এ বলা আছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সম্মানি বাংলাদেশি টাকায় উল্লেখ করতে হবে। ওয়েব ফন্টেইনের প্রস্তাবে বাংলাদেশি টাকায় সম্মানি দেওয়ার উল্লেখ ছিল না। এক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য (নন-রেসপন্সিভ) ঘোষণার পরিবর্তে এটিকে মাইনর ডেভিয়েশন হিসাবে বিবেচনা করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে।

দরপত্রের ভলিউম-১-এর সেকশন-৩-এর ২.৪ উপধারায় বলা আছে, প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কর্মকর্তাদের স্থানীয় প্রশিক্ষণ ও কল সেন্টার অপারেশনের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে অথবা সাব-কন্ট্রাক্টিং করতে পারবে। অথচ দরপত্র প্রস্তাবে ওয়েব ফন্টেইন শুধু নিজস্ব কল সেন্টার স্থাপনের বিষয় উল্লেখ করেছে, কোনো রূপরেখা দেয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে কল সেন্টার খুলতে গেলে অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) সদস্যপদ ও বিটিআরসির লাইসেন্স নিতে হয়। বর্তমানে বিটিআরসি কল সেন্টার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে। অন্যদিকে ওয়েব ফন্টেইন অথবা তাদের স্থানীয় অংশীদার স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই।

দরপত্রের ভলিউম-১-এর সেকশন-৩-এর ২.৪ উপধারায় লোকাল প্রতিনিধির জন্য কিছু যোগ্যতার শর্ত ছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল আইএসও ২৭০০১-এর সনদ। যেটা প্রথম পর্যায়ে বিডিংয়ে স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম জাল সনদ জমা দেয়। ক্লারিফিকেশন বৈঠকের প্রথম মিটিংয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিষ্ঠানটি সদুত্তর দিতে পারেনি। অনুসন্ধানে সার্টিফিকেশন সংস্থার ওয়েবসাইটে যাচাই করে সনদের তথ্য পাওয়া যায়নি। মূল্যায়ন কমিটি বিষয়টি জেনেও নীরব ভূমিকা পালন করে এবং প্রথম স্তরের ইভালুয়েশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।

এ বিষয়ে স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফোরকান বিন কাশেম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আইএসও সনদের অভিযোগ যাচাই করে আমাদের টিম আজ-কালের মধ্যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’ এরপর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাব্বির আহমেদ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, প্রথম পর্যায়ের মূল্যায়নে আইএসও সনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা ছিল। আমাদের জবাবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা সন্তুষ্ট হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আইএসও সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয় না। এজেন্সির মাধ্যমে সনদ গ্রহণ করতে হয়। এ সনদ নম্বর চাইলেই অনলাইনে যাচাই করা যায় না। যে এজেন্সির মাধ্যমে সনদ নেওয়া হয়, ওই এজেন্সির কাছে ভেরিফিকেশন কোড থাকে, যার মাধ্যমে সনদ যাচাই করা হয়। কোন এজেন্সির মাধ্যমে আপনারা সনদ নিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি জেনে জানাতে হবে।

এছাড়াও দরপত্রে উচ্চপদস্থ বিদেশি পরামর্শকের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া রয়েছে। সেই যোগ্যতা অনুযায়ী পরামর্শকদের জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) জমা দেওয়ার কথা ছিল প্রস্তাবে। প্রথম পর্যায়ে মূল্যায়নে ওয়েব ফন্টেইনকে বলা হয়, কী পারসনাল যেমন প্রজেক্ট ম্যানেজার, চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং টিম লিডার, বিএসডব্লিউ অপারেশন্স এক্সপার্ট, সলিউশন টেকনোলজি অ্যান্ড আর্কিটেকচার এক্সপার্ট, সিনিয়র ডেটাবেজ ডিজাইনার কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের যোগ্যতা অনুযায়ী জীবনবৃত্তান্ত দিতে। এছাড়া নন কী পারসনালের মধ্যে সফটওয়্যার ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট, কনফিগারেশন অ্যান্ড ডকুমেন্ট এক্সপার্ট, কমিউনিকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং এক্সপার্ট ন্যাশনাল, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কোচ (ন্যাশনাল), চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট এবং বিজনেস প্রসেস ইম্প্রুভমেন্ট পরামর্শকদের জীবনবৃত্তান্ত দিতে বলা হয়েছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বিতীয় পর্যায়ের মূল্যায়নে নতুন সিভির সঙ্গে কিছু পুরোনো সিভি জমা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে অনেক সিভি দরপত্রে উল্লিখিত যোগ্যতার সঙ্গে ম্যাচ করেনি। তারপরও মূল্যায়ন কমিটি সেগুলো গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ দরপত্রের ভলিউম-২ সেকশন-৭-এর ৮ উপধারা এবং অ্যাডেনডাম-১-এ বলা আছে, প্রজেক্ট ম্যানেজার (আন্তর্জাতিক) হতে হলে ১৫ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা লাগবে। কিন্তু ওয়েব ফন্টেইনের প্রদত্ত সিভিতে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির সিভি জমা দেওয়া হয়েছে। চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং টিম লিডারের সিভি প্রথম পর্যায়ে বাতিল করা হয়, ওই একই সিভি দ্বিতীয় পর্যায়ে জমা দেওয়া হয় এবং সেটি গ্রহণ করে মূল্যায়ন করেনি। বিএসডব্লিউ অপারেশন এক্সপার্ট পদে অ্যাডভান্স ডিগ্রি ইন ইকোনমিক্স অথবা অ্যাকাউন্টিং অথবা বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পড়ুয়াদের সিভি চাওয়া হয়। যেই ব্যক্তির সিভি দেওয়া হয়েছে, তিনি বায়ো ক্যামিস্ট্রি ডিগ্রিধারী। সলিউশন টেকনোলজি অ্যান্ড আর্কিটেকচার এক্সপার্ট পদে দরপত্র অনুযায়ী ১২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু জমা দেওয়া সিভিতে ১১ বছরের এক্সপেরিন্স পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিমসন লজিক বিশ্বব্যাংক ও এনবিআরে অভিযোগ দেয়। বিশ্বব্যাংকের একটি স্বতন্ত্র ইন্টিগ্রিটি কমিটি তদন্ত করছে। তদন্ত এখনো চলমান আছে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জাকিয়া সুলতানা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠান বেশি দর দিয়েছে, তারাই বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অযোগ্যতা কোথাও বলছে না। বেশি দর হাঁকানো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিলে তখন আপনারাই (সাংবাদিকরা) প্রশ্ন করতেন। তাছাড়া এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়নি। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রস্তাবটি আজ উঠবে। কমিটির সারসংক্ষেপে প্রকল্পের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি অনুমোদন দিলেই চূড়ান্তভাবে কাজ দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এ প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। তাদের অনাপত্তিসাপেক্ষে প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ থাকলে তারা অনাপত্তি দিত না।

ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা যায়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মালদ্বীপের ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় ওয়েব ফন্টেইন গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাজ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এডিবি অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। নাইজেরিয়ায় কাস্টমস আধুনিকায়নে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেছে। সেখানে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা কাস্টমসের সার্ভার ধীরগতি থাকায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি কেনাকাটায় সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে। কখন কী হয় বলা মুশকিল। এ প্রকল্পের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের অভিযোগ থাকলে এনবিআরের উচিত বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় পক্ষের (থার্ড পার্টির) মাধ্যমে দরপত্র প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়ন করা। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুটা বিলম্ব হলেও বিশ্বব্যাংক বা অন্য কারও প্রশ্ন বা সন্দেহ থাকলে তা দূর হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/657542