২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৯

ফের বাড়ছে বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম!

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে সাধারণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। তার ওপর বিদ্যুৎ-গ্যাসের উপুর্যপুরি দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলছে।

কিছুদিন আগে মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে গরিবের ঘাড়ে সব চাইতে বেশি বিদ্যুতের দাম চাপানো হয়েছে। জানা গেছে, ভর্তুকি হ্রাসে আগামী কুরবানির ঈদের আগে ফের দুই দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, আসন্ন রমযানের ঈদের পরে একবার এবং জুলাই মাসের মধ্যে একবার মোট দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। ঈদের পরে খুচরা পর্যায়ে বাড়ানো হবে ৫ শতাংশ। এটা নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া বাড়ানো হতে পারে গ্যাসের দামও। তবে গ্যাসের দাম কি পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে তা এখনও জানা যায়নি।

জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় এবং বাল্ক ট্যারিফের মধ্যে একটা বড় গ্যাপ রয়েছে। আবার বাল্ক ট্যারিফ যতটুকু বাড়ানো হয়েছে, খুচরা ততটুকু বাড়েনি। এখনও বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রায় ৫ শতাংশ গ্যাপে রয়েছে। দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। সেই ৫ শতাংশ যেকোনো সময় বাড়তে পারে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানো হবে, তবে রমযান মাসে গ্রাহকদের কষ্টের কথা চিন্তা করে সরকার এই সময়টায় দাম নাও বাড়াতে পারে।

সূত্র মতে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারই অংশ হিসেবে চলতি বছর প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত বিইআরসি। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ ছাড়া এক দফা বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। গত ১৭ জানুয়ারি শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত, যা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। এসবের পেছনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংস্কার। সংস্কারের মানে হচ্ছে ভর্তুকি কমানো, ভর্তুকি কমাতে হলে দাম বাড়াতেই হবে। তাই আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কমপক্ষে দুই দফা বাড়ানো হতে পারে বিদ্যুতের দাম।

সূত্র মতে, গত দুই মাসে ভোক্তা পর্যায়ে তিন দফায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী আদেশে ৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৪ক-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুতের খুচরা মূল্যহার এবং বিদ্যুৎ সম্পর্কিত বিবিধ সেবার জন্য চার্জ পুনঃনির্ধারণ করা হলো। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারন করা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে দুই দফায় ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয় বিদ্যুতের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী ভর্তুকি কমাতে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এপ্রিলে দাম বাড়ানোর ভাবনা থাকলেও রমযান মাস বিবেচনায় নিয়ে তা করা হচ্ছে না। কারণ এমনিতেই নিত্যমূল্যের অসহনীয় দামে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। সরকারের সমালোচনায় মুখর সবাই। তাই রমযানে না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তবে রমযানের পরই গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হবে। আর জুলাই মাসের মধ্যে আরও একবার বাড়ানো হবে। পাইকারিতেও বাড়ানো হতে পারে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার আর কোনো ভর্তুকি দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, জ্বালানি খাতে যতটা খরচ হচ্ছে, ভোক্তার কাছ থেকে ততটা অর্থই নেওয়া হবে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এফবিসিসিআই আয়োজিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিট-২০২৩-এর ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাপ্রোচ ফর এনার্জি সিকিউরিটি টু এটেইন সাসটেইনেবল গ্রোথ’ শীর্ষক সেমিনারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বৈশ্বিক সংকটের সময়ে জ্বালানি খাতের ভবিষ্যৎ একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারত যে দামে জ্বালানি কিনছে, সে দামেই বিক্রি করছে। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আর কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না। জ্বালানি খাতে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে, ভোক্তার কাছ থেকে সে পরিমাণ অর্থই নেওয়া হবে। তবে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হবে বলেও জানান তিনি।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর ধরে দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। এতে ঘাটতি বাড়ছে গড় উৎপাদন ব্যয় ও বিদ্যুতের দামে। তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ৯ টাকা ৪৪ পয়সা। যদিও ওই সময় বাল্ক মূল্যহার ছিল ৫ টাকা ৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান ছিল ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য চলতি অর্থবছর দাঁড়াবে ১১ টাকা ৫৪ পয়সা। দুই দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৪ টাকা ৮৪ পয়সা। আর আগামী অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য আগামী অর্থবছরে দাঁড়াবে ১১ টাকা ৮৫ পয়সা। বর্তমান বাল্ক মূল্যহার (৬ টাকা ৭০ পয়সা) বিবেচনায় প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৫ টাকা ১৫ পয়সা। চলতি অর্থবছরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ১৪ টাকা ৬ পয়সা। আর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বাড়ানোর পর বর্তমানে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। এতে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে লোকসান গুনবে ৫ টাকা ৮১ পয়সা।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, বিতরণ সংস্থাগুলো পিডিবির কাছ থেকে পাইকারিতে কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। এখন পাইকারির দাম যে হারে বাড়ছে সেই হারে খুচরা পর্যায়ের দাম না বাড়ানো হলে লোকসান হবেই। তাই দাম আরও বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাদের এখনও লোকসান হচ্ছে। আরও কমপক্ষে ৬-৭ শতাংশ দাম বাড়ানো হলে তাদের লোকসান হবে না। এটি সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, সমালোচনা হলেও কিছু করার নেই। যে হারে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, সে হারে খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। ফলে তাদের এখন লোকসান হচ্ছে। এভাবে তো বছরের পর বছর লোকসান দেয়া সম্ভব না। তাই বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতেই হবে।
এ বিষয়ে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, আগে পাইকারিতে প্রায় ১৯ শতাংশ ও ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর খুচরায় মোট ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি দিয়ে আমাদের হবে না, আরও বাড়াতে হবে।

এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির এক সদস্য বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর চাপ রয়েছে। তবে কি পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে তা এখনও জানা যায়নি। সূত্র বলছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো মার্জিন বৃদ্ধির আবেদন করেছে। তবে সংস্থাটির কারিগরি কমিটি বলছে, ইউনিট প্রতি বিদ্যমান ২৫ পয়সা চার্জ কোনো কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা নেই। ছয় বিতরণ কোম্পানির মধ্যে শুধু কর্ণফুলী ছাড়া অন্য পাঁচ কোম্পানির মার্জিন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম দেখিয়েছি পেট্রোবাংলা। সে কারণে গ্যাসের দাম বাড়াতে হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে জনজীবনে আরও অস্থিরতা নেমে আসবে। পরবর্তীতে দাম কমানো হলেও ভোক্তারা সে সুবিধা পাবেন না। অতীতে এর প্রমাণ রয়েছে জ্বালানির দাম কমলেও গাড়ি ভাড়া কমেনি।

উল্লেখ্য, গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছিল গত বছরের জুনে। গ্রাহক পর্যায় তখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিলো ২২.৭৮ শতাংশ। বছর না ঘুরতেই আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোর চলছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে জ্বালানি বিভাগ। বিদ্যুতের মতো গ্যাসের ক্ষেত্রেও নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে।

https://dailysangram.com/post/520080