২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৮

‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘নাশকতা’ শব্দ দুটি খুব বেশি শুনতে হচ্ছে

-ড. মাহবুব উল্লাহ্

বাংলাদেশে প্রায় সবাই আইনের শাসন চায়। দুর্ভাগ্যবশত এ দেশে আইনের শাসন লুপ্ত হয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। সেজন্যই আমি বলি, প্রয়োজন ভালো আইনের শাসন, কালো আইনের শাসন নয়। বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে বেশ কিছু কালো আইনের প্রচলন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা দৃষ্টান্ত হিসাবে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কথা বলতে পারি। মানুষকে হেনস্তা করার জন্য একটি আইন ব্রিটিশ শাসনামল থেকে অব্যাহত আছে। এটি হলো ৫৪ ধারার আইন। পুলিশ যদি মনে করে, কোনো ব্যক্তির চালচলন কিংবা আচরণ সন্দেহজনক, তাহলে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে থানা হাজতে এক রাত রেখে পরদিন আদালতে হাজির করতে পারে। আদালতের বিচারক এ ব্যক্তিকে মুক্ত করে দিতে পারে অথবা জেল হাজতেও পাঠাতে পারে। একজন মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার জন্য ৫৪ ধারার খক্ষ খুবই মারাত্মক। আইনের এ ধারাটি নাগরিকের স্বাধীনতা হরণের জন্য একটি মোক্ষম অস্ত্র।

১৮৬২ সালে ব্রিটিশরা এদেশে দারোগা আইন প্রচলন করে। এ আইন অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে দারোগা পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। দারোগাদের কোনো বেতন-ভাতা ছিল না। বলা হয়েছিল কমিউনিটির আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য দারোগারা কাজ করবেন। এ জন্য দারোগা সরকারি তহবিল থেকে কোনো বেতন ভাতা পেতেন না। ব্রিটিশ সরকার ভেবেছিল কমিউনিটিভুক্ত মানুষজন দারোগা সাহেবের চাওয়া পাওয়া পূরণ করবেন। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা আকারে দারোগাদের জন্য ‘ভ্যাট’ পাঠাত। এতেই দারোগা সাহেবদের খাওয়া-পরাসহ বিভিন্ন রকমের চাহিদা পূরণ হতো। ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের জন্য দারোগা সাহেবদের ধরতে গেলে পুরো ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল।

এ ঐতিহাসিক কাহিনি থেকে আমরা বুঝতে পারি দারোগা সাহেবরা কেন এত ক্ষমতাবান আর কেনই বা তারা যথেচ্ছাচারে জড়িয়ে পড়েন। এ ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। দারোগারা আজকাল সরকার নির্ধারিত বেতন-ভাতা পান। তবে আইনের নামে বে-আইনি কাজ করলে জবাবদিহিতা করতে হয়- সুশাসনের অবিচ্ছেদ্য এ অঙ্গটি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলো না। ব্রিটিশ শাসনামলের অবসানের ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের কথা না-ই বা বললাম, ৫০ বছরেরও অধিককালের বাংলাদেশ আমলে মানুষের এ আকাক্সক্ষাটি এখনো পূরণ হয়নি। ব্যাপারটি খুবই উদ্বেগের এবং লজ্জাজনক একটি ব্যাপার।

গত ২১ মার্চ মঙ্গলবার দৈনিক প্রথম আলো প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম দিয়েছে, ‘বনানী ক্লাবে খেতে গিয়ে বিএনপির ৫৩ জন গ্রেফতার’। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ৫৫ জন নেতাকর্মী গত রোববার রাতে রাজধানীর বনানী ক্লাবে খেতে গিয়েছিলেন। সেখানে হঠাৎ হাজির হয় পুলিশ। এরপর ক্লাব থেকেই ‘নাশকতার’ পরিকল্পনার অভিযোগে ৫৩ জনকে আটক করা হয়। মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির ওই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সোমবার সকালে বনানী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় দুজনকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

এদিকে গ্রেফতার করা নেতাকর্মীদের ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। তাদের প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিতে আবেদন করে ডিবি পুলিশ। আদালত ৫২ জনের দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আরেকজন অসুস্থ থাকায় তাকে জামিন দেয়। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মুন্সীগঞ্জের বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মোমিন আলীর আমন্ত্রণে অন্তত ৫৫ জন নেতাকর্মী বনানী ক্লাবে গিয়েছিলেন। তারা সবাই সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। মোমিন আলী বনানী ক্লাবের সদস্য। তিনি প্রায়ই ওই ক্লাবে যান। তার আমন্ত্রণেই সেখানে গত রোববার রাতে খেতে গিয়েছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলটির নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার খবর পেয়ে পুলিশও ক্লাবে যায়। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ৫৫ জনের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া আরও অজ্ঞাতনামা দশ থেকে পনেরো জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গ্রেফতারকৃত আসামিরাসহ আরও অজ্ঞাতনামা ১০-১৫ বিএনপির নেতাকর্মী বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণের নিমিত্তে জড়ো হন। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে জনসাধারণের মধ্যে এবং সরকারি স্থাপনা ও যানবাহনে নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রের শলাপরামর্শে লিপ্ত ছিলেন।
বর্তমান সময়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রিয় দুটি শব্দ হলো ‘নাশকতা’ ও ‘ষড়যন্ত্র’। এ দুই ধরনের কাজ করতে গেলে যথেষ্ট সাবধানতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয়। ৫৩ জন মানুষ মিলে খাওয়ার টেবিলে বসে সরকার কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ যদি নাশকতা করার কোনো ছক আঁকে, তাহলে সেই নাশকতা এ কান ও-কান হয়ে শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা ও সরকারের লোকজনের কানে পৌঁছে যাবে। এর ফলে ষড়যন্ত্রের ও নাশকতার কোনো গোপনীয়তা থাকবে না। আমাদের দেশের গোয়েন্দা বাহিনী গোপন খবর জানার জন্য সরকারি খরচে ‘সোর্স’ নামে একদল লোককে লালন-পালন করে। এদের কাজ হলো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের খবর সংগ্রহ করা এবং পালিয়ে থাকা অপরাধীদের আইনে সোপর্দ করার জন্য সহযোগিতা করা। অনেক সময় দেখা যায়, সোর্সরা একে অপরের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় দেখা যায়, শত্রুতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তার ফলে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে।

আমাদের জানামতে, সুদূর ঐতিহাসিক কাল থেকে রাজরাজড়া গুপ্তচর ও সোর্সের ব্যবহার করতো। এরা কোথাও রাজক্ষমতা উচ্ছেদের চেষ্টা হচ্ছে কিনা অথবা অন্য দেশীয়রা যুদ্ধবিগ্রহের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কিনা-এসব খবর তারা সংগ্রহ করত। সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য এসব চর ও সোর্সকে বিরাট অঙ্কের অর্থ প্রদান করা হতো। এই রীতি আজও অব্যাহত আছে। অতীতের তুলনায় বর্তমান যুগের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য সংগ্রহের জন্য অতি উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাধারণত খুবই উচ্চশিক্ষিত হন। কারণ তাদের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনিক আর্থিক ও সামরিক বিষয়াদি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। বর্তমান বিশ্বে সিআইএ, পেন্টাগন, ভারতের র, পাকিস্তানের আইএসআই, ইসরাইলের মোশাদ, ব্রিটেনের এমআই ফাইভ ও এমআই সিক্স এবং রুশ ফেডারেশনের এফএসবি ভয়াবহ গোয়েন্দা সংস্থা হিসাবে পরিচিত। অনেক সময় দেখা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শক্তিধর হয়ে ওঠে। তাদের কার্যকলাপ রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠে। অনেক সময় দেখা যায়, কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রে অথবা হাইব্রিড রাষ্ট্রে এ সংস্থাগুলো এতই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, এরা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং রাষ্ট্রের সিভিলিয়ান অঙ্গের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। একেই বলা হয় ‘ডিপ স্টেট’। অনেক সময় ডিপ স্টেটে পরিণত হওয়া সংস্থাগুলো এমনসব কাজ করে বসে, যা রাষ্ট্রের সিভিল অংশ গিলতেও পারে না, আবার উগড়ে ফেলতেও পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রের অন্তর্গত সোর্সগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট সীমারেখা এঁকে দিতে হয়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

 

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/657574