রাজধানীতে গণপরিবহনে উঠতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মুখোমুখি যাত্রীরা :নয়া দিগন্ত
২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৭

সিটিং সার্ভিস বৈধ : পিছু হটলো বিআরটিএ

কম স্টপিজ, সময় নিয়ন্ত্রণ, সিটিং সার্ভিসসহ বাহারি নাম নিয়ে রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো গণপরিবহনে যুক্ত হলেও পরিবহন মালিকদের চাপে পিছু হটেছে বিআরটিএ। আগামী ১৫ দিনের জন্য বৈধতা পেয়েছে সেই সিটিং সার্ভিস। এই সময়ের মধ্যে কোনো বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে না বলে জানা গেছে। তবে এসব পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য কোনোভাবেই থামছে না। বিআরটিএর ২০১৫ সালের তালিকানুযায়ী ভাড়ার হার কোনোভাবেই মানছে না পরিবহনগুলো। তালিকানুযায়ী সর্বনি¤œ ৫ টাকার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা, রুট ভেদে ১৮ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, ৩০ টাকার ভাড়া আদায় করছে ৫০ টাকা। এ নিয়ে যাত্রীদের সাথে হেলপার-ড্রাইভারের বাগি¦তণ্ডা, হাতাহাতির ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিআরটিএর তালিকানুযায়ী ভাড়া আদায় করার নিয়ম থাকলেও সিটিং সার্ভিসের ভাড়ার টিকিট কেটে গাড়িতে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। বেশির ভাগ বাসে বিআরটিএর ভাড়ার তালিকাও ঝুলানো নেই। সিটিং সার্ভিস বন্ধের প্রথম দিন থেকে গতকাল চতুর্থ দিনেও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চিত্র এমনই ছিল।
যাত্রীদের অভিযোগ, পোস্তাগোলো-জুরাইন থেকে গুলিস্তান আনন্দ ও বোরাক পরিবহন ভাড়া আদায় করেছে ১৫ টাকা। কিন্তু চার্টে আছে ১১ টাকা। দোলাইরপাড় থেকে গুলিস্তান ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা নেয়া হচ্ছে। গুলিস্তান থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত যেখানেই নামেন ভাড়া ১৫ টাকা। সেটা দোলাইরপাড় কি জুরাইন কি পোস্তগোলা। এই দুই বাস গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ যায়। সিন্ডিকেট করে পরিবহন ব্যবসা করায় ওই রুটে অন্য কোনো পরিবহন ঢুকতে পারে না। কাউন্টারও আছে দোলাইরপাড়ে, জুরাইনে, পোস্তগোলায়। এই পরিবহনে গুলিস্তান থেকে পাগলা ফতুল্লাহ নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ২০ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা, আর ২৫ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। মিরপুর থেকে সায়েদাবাদে আসে শিকড়, শিখর, খাজাবাবাসহ বেশ কয়েকটি পরিববহন। বিকেলে পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, জাতীয় প্রেস কাবসহ বেশ কয়েকটি স্পটে গিয়ে দেখা যায়, বাসের মধ্যে গাদাগাদি করে যাত্রীরা ওঠানামা করছেন। তবে ভাড়া কম নেয়া হয়নি। আগের ভাড়া গুলিস্তান পর্যন্ত ২৫ টাকা এবং সায়েদাবাদ পর্যন্ত ৩০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এই ভাড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নেয়ার নিয়ম। মিরপুর ১ থেকে শাহবাগের বাসভাড়া তালিকা অনুযায়ী ১৬ টাকা। কিন্তু দিশারী পরিবহন নিয়েছে ২৫ টাকা। মতিঝিল থেকে মিরপুরের দিকে নিউভিশন, বিকল্প পরিবহন, মিরপুর-১২সহ বেশ কয়েকটি বাস সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে চলাচল করত। গতকালও ওই বাসগুলো আগের ভাড়া ২৫ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেছে। ফার্মগেট থেকে মিরপুর পর্যন্ত আদায় করেছে ১৫ টাকা। মতিঝিল থেকে প্রেস কাব যেখান থেকেই যাত্রী উঠুক না কেন ভাড়া ১০ টাকা গুনতে হচ্ছে। মালঞ্চ পরিবহনে আগে টিকিট কেটে যাত্রীদের গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে। টিকিট অনুযায়ী, প্রেস কাব থেকে মোহাম্মদপুরের ভাড়া ২০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বিআরটিসি পরিবহনে (এসি) প্রেস কাব থেকে আব্দুল্লাহপুরের ভাড়া টিকিট অনুযায়ী ৬০ টাকা নেয়া হচ্ছে। সাভার থেকে মতিঝিলগামী ওয়েলকাম পরিবহন গতকালও আগের ভাড়া ৫০ টাকা আদায় করেছে। গাবতলী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নেয়া হয়েছে আগের ভাড়া ২৫ টাকা। তবে এই একই পথের দূরত্বে গুলিস্তান-ধামরাই পরিবহন, শুভযাত্রা পরিবহনে নেয়া হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। প্রেস কাব থেকে ফার্মগেট ১০ টাকা, ফার্মগেট থেকে আসাদগেট, কলেজগেট, শ্যামলী কল্যাণপুর গাবতলী পর্যন্ত যেখানেই যাত্রী নামেন না কেন ১৫ টাকা, মতিঝিল থেকে গাবতলী ২৫ টাকা, মতিঝিল থেকে মিরপুর ২৫ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। যা ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেয়ার নিয়ম রয়েছে। ফার্মগেট থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ২.৯ কিলোমিটার ভাড়া ৫ টাকা, শেওড়াপাড়ার দূরত্ব ৪.৬ কিলোমিটার বাসের ভাড়া ৮ টাকা, মিনিবাসের ভাড়া ৭ টাকা, মিরপুরের দূরত্ব ৬.০৪ কিলোমিটার বাসের ভাড়া ১১ টাকা, মিনিবাসের ভাড়া ১০ টাকা হলেও এখানে ১৫ ভাড়া নেয়া হয়। দূরত্ব ভেদে কোথাও দ্বিগুণ আবার কোথাও দেড়গুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। প্রেস কাব থেকে মোহাম্মদপুর দূরত্ব ৭.৭ কিমি. বাসের ভাড়া ১৩ টাকা, মিনিবাসের ভাড়া ১২ টাকা। নীলতে থেকে ঢাকা সিটি কলেজ দূরত্ব ২.৭ কিমি. বাসের ভাড়া ৭ টাকা, মিনিবাসের ভাড়া ৫ টাকা। ঝিগাতলা-মোহাম্মদপুর ২.৪ কিমি বাসের ভাড়া ৭ টাকা মিনিবাসের ভাড়া ৫ টাকা। এই রুটে চলে মৈত্রী, দীপন, সিটি বাস, মেশকাত, মিডওয়েসহ বেশ কয়েকটি পরিবহন। সব পরিবহনই সর্বনি¤œ ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে। এতে যাত্রীদের সাথে হেলপারদের ধাক্কাধাক্কি লেগেই আছে। মোহাম্মদপুর থেকে মহাখালী হয়ে বসুন্ধরার দূরত্ব ১৩ কিমি. বাসের ভাড়া ২২ টাকা মিনিবাসের ভাড়া ২০ টাকা। এই রুটে বাসের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। যখন যেখানে যেমন তেমন ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে হেলপার-কন্ডাক্টরেরা। ভাড়ার এই নৈরাজ্যের মধ্যে গতকাল বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বিআরটিএর কার্যালয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে সংস্থাটির এক রুদ্ধদার বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে ১৫ দিনের জন্য সিটিংবিরোধী অভিযান বন্ধ ঘোষণা করা হলো। এই সার্ভিসকে একটা নিয়মের ভেতরে আনতে চাই। সিটিং সার্ভিস চলবে। তবে বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া নিতে হবে। ভাড়া কোনো অবস্থাতেই বৃদ্ধি করা যাবে না। তিনি জানান, ১৫ দিন পর পরিবহন মালিক, যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিটিং সার্ভিসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
গত ৪ এপ্রিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে সিটিং সার্ভিস প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া যানবাহন থেকে অবৈধ সাইড অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলা এবং সিটিং সার্ভিস বন্ধসহ পরিবহন খাতের সমস্যা সমাধানে করণীয় ঠিক করতে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপ (বিআরটিএ) ও মালিক-শ্রমিক নেতারা গত শনিবার এলেনবাড়িতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রোববার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়াও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, ১৫ এপ্রিলের পর যাত্রীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া যাবে না। ভাড়ার তালিকা বাসে দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। ছাদের ওপরে ক্যারিয়ার, সাইড অ্যাঙ্গেল ও ভেতরের অতিরিক্ত আসন খুলে ফেলতে হবে। প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আসন সংরণ করতে হবে। এক মাসের মধ্যে রঙচটা, রঙবিহীন, জরাজীর্ণ বাস মেরামত করে রাস্তায় নামাতে হবে। মোটরযান আইন অনুসারে, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। চালকের আসনসহ মিনিবাসে ৩১টি আসন থাকবে। আর বিআরটিএ পরিবহন খাতের ২০টি বিষয়ে ব্যয়ের খাত বিশ্লেষণ করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/213537