২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ১০:৩০

পবিত্র মাস রমযান এবং মানুষের কষ্ট

-আশিকুল হামিদ

বছর ঘুরে আবারও এসেছে পবিত্র মাস রমযান। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে বাংলাদেশে আগামী ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার থেকে রমযান শুরু হতে পারে। মাসটি শুধু পবিত্র নয়, আল্লাহ তা’লার সান্নিধ্য ও রহমত এবং গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্যও শ্রেষ্ঠ মাস এই রমযান। সুরা আল বাকারাহর ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম (অর্থাৎ রোযা) ফরজ করা হয়েছে যেমনভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো”।

রোযা সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বর্ণনার দরকার পড়ে না। সুবহে সাদিক বা ফজরের ওয়াক্ত থেকে মাগরিব তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকাটা অবশ্যই সহজ কাজ নয়। কোনো মানুষ দেখবে না জেনেও মুসলিমরা লুকিয়ে কিছু খান না। পানও করেন না। কারণ, তারা জানেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবই দেখছেন। আর রোযা যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সেহেতু কষ্ট যতো বেশিই হোক, মুসলিমরা রোযা ভাঙেন না। এর মধ্য দিয়ে তারা একদিকে অনাহারক্লিষ্ট গরীব মানুষের জীবন যন্ত্রণা বোধ করতে শেখেন, অন্যদিকে পরীক্ষা দেন ধৈর্যের। রোযাদাররা অন্যদের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষাও লাভ করেন।

রোযা মানুষকে চরম ধৈর্য শিক্ষা দেয়। আল্লাহ অবশ্য তাঁর এই বান্দাদের জন্য সীমাহীন কল্যাণ রেখেছেন। রমযানে রহমতের দরোজাও তিনি খুলে দেন। সামনে হালাল খাদ্য ও পানীয় এবং তা গ্রহণ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছুই না খেয়ে ইফতারের নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন মুসলিমরা। একমাস ধরে রোযা রাখার তথা সংযম পালনের পেছনেও তাদের জন্য রয়েছে নানামুখী কল্যাণ। এ মাসে পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি চিন্তা ও কাজকর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রেও নিজেদের পরিশিলীত রাখেন মুসলিমরা। তারা কোনো অন্যায় কাজে অংশ নেন না, কারও সঙ্গে বিবাদে জড়ান না, অন্যের ক্ষতির চিন্তা তো এড়িয়ে চলেনই। সব মিলিয়েই রমযানের দিনগুলোতে মুসলিমরা আত্মশুদ্ধির এবং আল্লাহ তা’লার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। আল্লাহ তা’লাও দান করেন প্রচুর পরিমাণে। তিনি গুনাহগার বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ দেখান এবং তাদের মাফ করে দেন। ভালো কাজ না করার কারণে যারা দরিদ্র ও হীন অবস্থায় থাকে তারাও এ মাসের মাহাত্ম্যে এবং তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হয়ে উঠতে পারে।

রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার দ্বিতীয় কারণ পবিত্র লাইলাতুল কদর। ২৬ রমজানের দিন শেষে, অর্থাৎ ২৭ তারিখে- অনেকের মতে রমযান মাসের শেষ ১০ দিনের যে কোনো বেজোড় তারিখের রজনীতে হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল শুরু হয়েছিল। আল-কোরআন এমন একটি মহাগ্রন্থ, যার মধ্যে আল্লাহর নাজিল করা পূর্ববর্তী সব গ্রন্থের সারবস্তু তথা সারকথা এবং ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌল নির্দেশনা একত্রিত করা হয়েছে। বস্তুত আকাশ ও মাটিতে তথা সমগ্র সৃষ্টি জগতে এমন কোনো গোপন রহস্য নেই যার উল্লেখ আল-কোরআনে না আছে।
পবিত্র এ গ্রন্থটিকে আল্লাহ মানুষের জন্য জীবন বিধান হিসেবে পাঠিয়েছেন। মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতের গুহায় শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ সুরা কদরে আল্লাহ আরও বলেছেন, ‘এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।’ এই রাতে বেশি বেশি ইবাদতের তাগিদ দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি নিজেও কদরের সারারাত আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। শুধু এই একটি রাত্রি নয়, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ ১০দিনই ইতিকাফ করতেন- যার অর্থ পৃথিবীর সব কাজ ছেড়ে কেবলই আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন থাকা এবং আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমতের জন্য মোনাজাত করা। গুনাহর জন্য মাফ চাওয়া।

এজন্যই কদরের রাতকে যারা পাবেন তারা খুবই সৌভাগ্যবান এবং তাদের উচিত আল্লাহর কাছে সর্বান্তকরণে নিজেদের সমর্পণ করা, তাঁর পানাহ চাওয়া। শিক্ষা চাকরি ব্যবসা এবং শারীরিক সুস্থতা ও সহজ-সরল জীবন যাপনের সাধ্য দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’লার কাছে বিশেষভাবে মোনাজাত করা। কেবলই নিজের জন্য চাওয়ার পরিবর্তে দেশ ও জনগণের জন্যও আল্লাহর রহমত চেয়ে মোনাজাত করা উচিত।

রমযানের পবিত্র মাসে মুসলিমদের উচিত আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমতের জন্য মোনাজাতে নিমগ্ন থাকা। গুনাহ থেকেও মাফ ও মুক্তি চাইতে হবে। কারণ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতেপূর্ণ জীবনে মানুষ প্রতিদিনই অনেক গুনাহ বা অপরাধ করে- তা ইচ্ছায় হোক বা হোক অনিচ্ছায়। অন্যদিকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহ গুনাহগার বান্দাদের মাফ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাভিচারী, মুশরিক ও নাস্তিক-মুরতাদ ছাড়া বান্দাদের সব নেক বা ভালো আশা-আকাক্সক্ষা রমযানের মাসে আল্লাহ পূরণ করেন। এমন একটি সুযোগকে অবশ্যই হাতছাড়া করা অনুচিত। কারণ, মনে ইবাদত ও ভালো কাজের স্পৃহা তৈরি হলে কারো পক্ষে খারাপ কাজ বা গুনাহ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রত্যেক মুসলিমেরই উচিত নিজেদের পাশাপাশি জনগণের কল্যাণ এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণখুলে মোনাজাত করা।

বলা দরকার, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রমযান পালনের পাশাপাশি সামগ্রিক বাস্তবতার আলোকেও নতুন করে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। কারণ, সরকারের ব্যর্থতা এবং চাঁদাবাজি, হাজার হাজার কোটি টাকার অংকে অর্থ পাচার ও কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে টাউট ব্যবসায়ীরা রমযান মাসে মুসলিমসহ জনগণকে সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেয়। মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে পানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণেও। এজন্যই মুসলিমসহ জনগণের উচিত সরকারের ব্যর্থতা ও দ্রুত বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। ব্যবসায়ীদের উচিত অন্তত এই একটি মাসে রোযাদারসহ মানুষকে কম কষ্ট দেয়া। সম্ভব হলে কষ্টই না দেয়া। আর সরকারের উচিত প্রতিটি বিষয়ে সততার সঙ্গে তৎপর থাকা, যাতে রোযাদার মুসলিমদের কষ্ট কম হয়।

অন্যদিকে পবিত্র রমযান শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকে এবারও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যবসায়ী-মহাজনরা সর্বাত্মকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে মূল্য পরিস্থিতিও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করেছে। গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, একের পর এক পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে ব্যবসায়ী-মহাজনরা। পেঁয়াজ-রসুন ও ডাল থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি পর্যন্ত তো বটেই, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চিনি, লবণ ও সয়াবিনসহ নিত্যপণ্যের সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে। রমযানের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছোলার ব্যাপারে বাজারে রীতিমতো আতংক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছ্,ে এবারের রমযানে মানুষকে অনেক বেশি দামে ছোলা কিনতে হবে। তাছাড়া বাজারে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে গোরু ও খাসির মাংস এবং মুরগির দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতাও শুধু শুরু হয়নি, এই প্রতিযোগিতা কল্পনার সীমাও ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষুদে ব্যবসায়ীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, মুদি দোকানদার ও সরকারের পক্ষ থেকে যদি মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার তদারকি করার ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এবারের রমযানে মানুষের কষ্টের কোনো সীমা থাকবে না।

এক কথায় বলা যায়, এবারও রমযানের আগেই সব মিলিয়ে বাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে পড়েছে। নাম ধরে ধরে কোনো সবজির দাম পৃথকভাবে উল্লেখ না করেও বলা যায়, প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। তা সত্ত্বেও রমযানের মধ্যে মানুষকে বাজারে যেতেই হবে। কারণ, স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি রমযানে রয়েছে ইফতারি ও সাহরি খাওয়ার বাড়তি বিষয়। সুতরাং বেশি দাম দেয়ার সাধ্য না থাকলেও বাজারে না গিয়ে উপায় থাকবে না মানুষের। অতীতে সব সময়, এমনকি গতবারের রমযানেও একই অবস্থা দেখা গেছে। সেজন্য সঙ্গত কারণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, কোনো পণ্যের দামই রাতারাতি বা কেবলই রমযান মাসকে সামনে রেখে বাড়ায়নি ব্যবসায়ী-মহাজনরা। দাম বেড়ে আসছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু কোনো পর্যায়ে, কোনো বছরই ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস শোনানোর বাইরে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাজার সংশ্লিষ্টরা বরং বলেছেন, রমযান আসার এবং পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার পর মন্ত্রীরা বড়জোর ব্যবসায়ী-মহাজনদের ভয় দেখানোর অভিনয় করবেন। শোনাবেন, বাজারের ব্যাপারে ‘কঠোর নজরদারি’ করা হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ ওপর দোষ চাপাতেও পিছিয়ে থাকবেন না মন্ত্রী এবং কর্তা ব্যক্তিরা।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী-মহাজনরা যে কোনো ধমককেই পাত্তা দেবে নাÑ সে কথাটাও আগেভাগে জানিয়ে রাখা হচ্ছে। কারণ, সরকার যা কিছুই বোঝাতে চাক না কেন, ভুক্তভোগী মানুষ কিন্তু ঠিকই জানে, তারা বুঝতেও পারে- এই ব্যবসায়ী-মহাজনদের সঙ্গে সরকারের ‘অতি চমৎকার সম্পর্ক’ রয়েছে। সে কারণেই সরকারের কোনো কথায় কান দেয়ার দরকার বোধ করে না তারা। আর এই ‘অতি চমৎকার সম্পর্কের’ পেছনে যে চাঁদা ও কমিশন ধরনের কিছু ফ্যাক্টর বা নির্ধারক যে রয়েছে সে কথাটাও কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। এ ব্যাপারেও মানুষের অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর নয় বরং অত্যন্ত তিক্ত। নাহলে কথিত ‘কঠোর নজরদারি’ সত্ত্বেও প্রতি বছরই রমযানের প্রাক্কালে নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারতো না।

বলা বাহুল্য, চাঁদা ও কমিশনসহ সহজবোধ্য কিছু কারণে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে ব্যবসায়ী-মহাজনরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যথেচ্ছভাবে। এবারও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেছে রমযানের আগে থেকেই। একই কারণে দামও চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। নাভিশ্বাস উঠেছে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের।

অন্যদিকে ধর্মপরায়ণ মুসলিমরাসহ সাধারণ মানুষ মনে করেন, অসৎ ও মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ী-মহাজনদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনা। চিনি ও ছোলার মতো জরুরি কিছু পণ্য বিক্রির ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই ওএমএস ধরনের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বলা দরকার, মনিটরিং করে দাম বাড়ানোর অপতৎপরতাকে প্রতিহত না করা গেলে পণ্যের দাম আরো বাড়তেই থাকবে। সরকার যতোই ‘কঠোর নজরদারি’র প্রশ্নসাপেক্ষ পদক্ষেপ নিক না কেন, রমযানে মানুষ কোনো সুফলই ভোগ করতে পারবে না। মানুষকে বরং সীমাহীন কষ্টের শিকার হতে হবে। এজন্যই সরকারের উচিত মূল্য কমানোর ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখনই তৎপর হয়ে ওঠা।

 

https://dailysangram.com/post/519729