১৯ মার্চ ২০২৩, রবিবার, ১১:৪৫

যারা হজ্ব প্যাকেজের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করেছেন তারা পাপের ভাগী হয়েছেন: মাননীয় হাইকোর্ট

-আসিফ আরসালান

ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গানে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বদাই মুখর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে যে সংবিধান গৃহীত হয় সেই সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন মহল আশঙ্কা প্রকাশ করলে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে যে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্ম হীনতা নয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষ ঐ ধরনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কিন্তু তবুও তৎকালীন পরিস্থিতির কারণে তাদের করার কিছু ছিল না। যাই হোক, জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর জনগণের পাল্স সঠিকভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি সংবিধান সংশোধন করেন এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মাথার ওপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বাক্যটি উৎকীর্ণ করেন। এছাড়া সংবিধান থেকে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র বাদ দেন। পরিবর্তে সামজিক ন্যয় বিচার এবং সব ধর্মের স্বাধীনতার ওপর জোর দেন।

এরপর আওয়ামী লীগ যখন তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে তখন তারা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ধর্ম নিরপেক্ষতা আবার সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেন। কিন্তু তারপর ১৪ বছর পার হতে চলল। এরমধ্যে বুড়িগঙ্গার তল দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা বললেও এই ১৪ বছরে এই সরকার অনেক কাজ করেছে যা মুসলমানদের ধর্মানুভূতিকে আহত করেছে। ১৪ বছরে এই ধরনের অনেকগুলো কাজ হয়েছে, যার ফিরিস্তি দিতে হলে অনেক সময় লাগবে। সর্বশেষ আঘাত এসেছে পবিত্র হজ্বব্রত পালনের ওপর। অবশ্য একথাটি এভাবে বলা যাবে না যে সরকার হজ¦ব্রত পালনের ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু আগামী হজ্বের জন্য হজ্ব পালনের প্যাকেজের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে তা অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের হজ্ব করার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।

সকলেই জানেন যে পবিত্র ইসলামের প্রধান ৫ টি স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হলো হজ্ব। হজ্ব যদিও মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে, তবুও সেখানে একটি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, যে ব্যক্তি শারীরিকভাবে সুস্থ এবং অর্থনৈতিকভাবে হজ্বের খরচ বহন করার সামর্থ যার রয়েছে সেই ব্যক্তির জন্য হজ্ব করা ফরজ। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে হজ্ব করতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকতে হবে।

এবছরের আগে পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে হজ্ব প্যাকেজের মূল্য যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, মানুষ অনেক কষ্ট করে হলেও সেই টাকা জোগাড় করেছেন এবং পবিত্র হজ¦ব্রত পালন করেছেন। হজ্ব পালনের ইচ্ছা মুসলমানদের মধ্যে এমন তীব্র যে গরীব এবং মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার হজ্ব পালন করবেন, এই আকাক্সক্ষা এবং ইচ্ছাকে সামনে রেখে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাদের দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ যতদূর সম্ভব কাটছাঁট করেছেন এবং হজে¦র টাকা জমিয়েছেন। আমরা সকলেই এমন অনেক পরিবারকে জানি যারা ১০/১৫ এমনকি ২০ বছর পর্যন্ত টাকা জমিয়েছেন এবং জমানো টাকা দিয়ে বহু কাক্সিক্ষত হজ্ব পালন করেছেন। এভাবে যারা কষ্ট করে টাকা জমান তারা যখন পবিত্র কাবা শরীফের সামনে হাজির হন, অযু করে নামায পড়েন এবং এক দৃষ্টিতে কাবা ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকেন তখন তাদের হৃদয় মন সবকিছু জুড়িয়ে যায়। তারা হৃদয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করেন এবং বছরের পর বছর ধরে টাকা জমানোর যে কষ্ট করেছেন সেই কষ্ট ভুলে যান।

তবে কষ্ট করে টাকা জমানোরও তো একটা সীমা আছে। মানুষ অসম্ভবকে কোনো দিন সম্ভব করতে পারে না। তবে যেটিকে সম্ভব করা যায়, কিন্তু সেই সম্ভব করাটা কষ্টসাধ্য, সেটি তারা দুঃসাধ্য চেষ্টা করে সম্ভব করে তোলেন। এতদিন ধরে একভাবে চলেছে। কিন্তু এবার সরকার হজ¦ প্যাকেজের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেটি সমস্ত সহ্য শক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কেন, কিভাবে এবং কোন যুক্তিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় এই রকম অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য নির্ধারণ করলো তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এরফলে হাজার হাজার মানুষ আছেন যাদের শুধু ইচ্ছাই ছিল না, যারা বছরের পর বছর কষ্ট করে লাখ চারেক টাকা জোগাড় করেছেন, তাদেরও তাদেরও হজ¦ করার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়েছে।

॥ দুই ॥
উচ্চ হারে হজ্ব প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ এমন স্বৈরাচারী কা- যে এ ব্যাপারে খোদ মাননীয় হাইকোর্টও এটার তীব্র সমালোচনা করেছেন। মাননীয় হাইকোর্ট এই উচ্চ মূল্যের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি ‘অথর্ব’ মন্ত্রণালয়। আর যে প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি ‘অমানবিক’। নির্ধারিত প্যাকেজকে হাইকোর্ট আরো বলেছেন যে ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘অযৌক্তিক’। গত ১২ মার্চ হজ্ব প্যাকেজের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। রিটে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স ছাড়াও অন্য যেকোনো এয়ারলাইন্সের টিকেটে হজ্বে যাওয়ার নির্দেশ প্রার্থনা করা হয়েছে। এর আগে হজ প্যাকেজের খরচ কমিয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলতি মৌসুমে হজের খরচ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। অন্যদিকে কোরবানি ছাড়াই এবার বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য সর্বনিম্ন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। আগের বছর এটি ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে দেড় লাখ টাকা বেড়েছে।

বাংলাদেশ সরকার এবং সৌদি সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিত চুক্তি অনুযায়ী এবছর বাংলাদেশের হজ্ব যাত্রীর কোটা নির্ধারিত হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন পবিত্র হজ্ব পালন করতে পারবেন।

ডেইলি স্টারের ১৪ মার্চের রিপোর্ট মোতাবেক হাইকোর্ট বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতিদ্বয় যথাক্রমে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিচারপতি মোহাম্মদ আলী শুনানিকালে মন্তব্য করেন যে যারা এই হজ্ব প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণের সাথে জড়িত তারা ‘পাপের ভাগী’ Sharers of the sin হবেন। সর্বশেষ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বছরের হজ্বের জন্য নিবন্ধনের সময় একের পর এক বাড়িয়েই চলেছেন। ৩ বা ৪ বার সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ করা হয়েছে ১৬ মার্চ। সর্বশেষ যে তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে এপর্যন্ত ৫০ হাজার ব্যক্তিও নিবন্ধন করেননি। কারণ নিবন্ধন করার জন্য গত বছরের তুলনায় এবার অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা লাগছে। যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম কেদারায় বসে এই অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা ধার্য করেছেন এটা তাদের বোঝারই ক্ষমতা নাই যে এই অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা জোগাড় করতে মধ্যবিত্তদের কয়েক বছর লেগে যাবে।

তবে মাননীয় হাইকোর্ট এ ধরনের কঠোর কিন্তু সঠিক মন্তব্য করলেও তারা হজ্ব প্যাকেজের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করে দেননি। দাম কমানোর ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলার জন্য মাননীয় হাইকোর্ট এ্যাটর্নি জেনারেলকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিমান ভাড়া ৫০ হাজার টাকা কমানোর সুপারিশ করেছেন।

॥ তিন ॥
এবারের প্যাকেজে বিমান ভাড়া ধরা হয়েছে হাজি প্রতি ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৪ হাজার ৪৪ টাকা। দৈনিক সংগ্রামের এই কলাম লেখক সহ বাংলাদেশের বহু নর নারী পবিত্র হজ¦ব্রত পালন করেছেন। অতীতে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে জেদ্দা যাওয়া আসার ভাড়া, অর্থাৎ রাউন্ড ট্রিপ ৮০ হাজার টাকারও কম। ঢাকা থেকে জেদ্দা যেতে সময় লাগে সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। পক্ষান্তরে ঢাকা থেকে অস্ট্রেলিয়া যেতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা। অথচ এই সেদিনও এক ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। তার রাউন্ড ট্রিপ ভাড়া লেগেছে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে এবার বিমান ভাড়া কোন যুক্তিতে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা ধরা হয়েছে?

ভারতীয় হজ্ব কমিটির ওয়েবসাইট মোতাবেক এ বছর ভারতে প্রতি হাজির প্যাকেজ ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৯৯ হাজার রুপি। সেখানে প্রতি হাজিকে ভর্তুকি দেওয়া হবে ১ লক্ষ টাকা। ১৬ মার্চেও বিজেপির প্যারেন্ট সংগঠন আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বলেছেন। তারপরেও তারা মুসলমানদের হজ্বে প্রতি হাজিকে ১ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ প্রতি হাজির নিজস্ব খরচ পড়বে ৩ লক্ষ রুপি। যেটি বাংলাদেশী মুদ্রায় রুপান্তরিত করলে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকার বেশি হবে না। সেখানে ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে প্রতি হাজির খরচ পড়বে প্রায় ৭ লক্ষ টাকার বেশি।

মাননীয় হাইকোর্ট তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশে হজ্বের জন্য সরকার আলাদা বরাদ্দ রাখে। আমাদের এটি নেই কেন? এই প্রশ্নের জবাব কি দেবে আমাদের সরকার? আমরা যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই সরকার ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কি ধর্ম হীনতা বোঝাচ্ছেন? তাদের কার্যকলাপে তো তেমন আলামতই পাওয়া যাচ্ছে।

হোটেল ভাড়া ২ লক্ষ টাকা কিভাবে হয়? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, প্রতি রুমে ৮ টি খাট বা চৌকি থাকে। অর্থাৎ এক রুমে ৮ জনকে ঘুমাতে হয়। অথচ আমি এজেন্টদেরকে প্যাকেজ মূল্যের চেয়ে দেড় গুন বেশি টাকা দিয়েছিলাম এই শর্তে যে তারা আমাদের ডাবল সিটেড রুম দেবে। অর্থাৎ এক ঘরে দুই জন থাকবে। এছাড়া যে খাওয়া দাওয়া দেয় সেগুলো মুখে তোলা যায় না। তাই অধিকাংশ বাংলাদেশী হাজিকে দেখা গেছে দুই বেলাই হোটেলে খেতে, যদিও তারা খাওয়ার জন্য আলাদা টাকা দিয়েছেন।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো এই যে আমাদের পাপের ভাণ্ড পুরো হয়ে গেছে। হজ্বের মত শুধু পবিত্র নয়, একটি ফরজ কাজকেও আমরা ব্যবসা বাণিজ্যের পণ্যের মত পণ্য হিসাবে গণনা করছি। আমরা বাংলাদেশীরা হজ্ব এজেন্সীর মালিকের অনুপস্থিতিতে মোয়াল্লেমকে ওয়াদা ভঙ্গের জন্য গালি গালাজ করি না। কারণ সকলে বিশ্বাস করেন যে হাজিরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহর ঘরে যারা যাচ্ছেন তারা। তাদেরকে ক্রোধ, রাগ এগুলো সব বিসর্জন দিতে হবে। তবে প্রতি বছর প্রায় সমস্ত হাজি হজ্ব থেকে ফিরে এসে এক বাক্যে বলেন যে প্রায় সমস্ত হজজ্ব এজেন্ট জোচ্চোর এবং বাটপাড়। এরা আল্লাহর হুকুম নিয়ে ব্যবসা করে। এদের শাস্তি আল্লাহ দেবেন। কিন্তু সরকার যে অমানবিক জুলুম করছে তার বিচার কে করবে? সে বিচার তো করতে হবে জনগণকেই।

https://dailysangram.com/post/519650