নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম প্রধান উপকরণ রড। কিন্তু এই রডের দামই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বর্তমানে লাখ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের শেষ দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতি টন রড বিক্রি হয়েছে এক লাখ ৫০০ টাকা থেকে এক লাখ ২ হাজার টাকায়। দেশের শীর্ষ তিন ব্র্যান্ডের রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের রড এখন লাখ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তবে দেশীয় ইস্পাত শিল্পের লোহার রড পাওয়া যাচ্ছে লাখ টাকার কিছুটা কমে। এই রড টনপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৯৮ হাজার ৫০০ টাকায়।
প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে রডের দাম। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে গত এক মাসের রডের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখন প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৫০০ টাকায়। মাত্র এক মাস আগেও এ রডের দাম ছিল ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা। আর পাঁচ মাস আগেও এই রডের দাম ছিল টনপ্রতি ৮৪-৮৫ হাজার টাকা। ফলে গত পাঁচ মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ১৪-১৫ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প, আবাসন খাত ও গ্রামাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে রডের চাহিদাও বেড়েছে বেশ। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছুতেই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি তেলের দাম এবং চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আর এতে বাড়ছে মাইল্ড স্টিল (এমএস) রডের দাম, যা এবার ইতিহাস গড়ে দেশের বাজারে লাখ টাকা টন ছাড়ালো। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের মূল্যবৃদ্ধি, ফ্রেইট চার্জ এবং ডিজেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে।
এ বিষয়ে রাজধানী বাড্ডার মেসার্স পাটোয়ারী স্টিল করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী বাবুল পাটোয়ারী জানান, বিএসআরএম রডের টন ১ লাখ ২ হাজার আর কেএসআরএম রডের টনের দাম ১ লাখ ১ হাজার টাকা। রডের দাম বাড়ার খবর তো নতুন না। কয়েক দিন ধরেই দাম বাড়ছিল। দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কিছুটা কমে গেছে। কারণ মানুষেরও তো একটা ক্রয়ক্ষমতা আছে। ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে তো মানুষের যেকোনো কিছুই কিনতে সমস্যা হবে।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার বিএসআরএম ব্র্যান্ডের রড প্রতি টন এক লাখ ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে একেএস ও জিপিএইচ ইস্পাতের রডের দামও কাছাকাছি। শুধু কেএসআরএমের রড কিছুটা কমে বিক্রি হচ্ছে। অনেক কোম্পানিতে রডের মজুতও নেই। মজুত না থাকায় জোগানে ঘাটতি হচ্ছে। ফলে রডের দাম কমাচ্ছে না।
রডের দামের বিষয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে রডের দাম হু হু করে বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডে ১০-১২ হাজার টাকা বেড়েছে। এখন কয়েকটি কোম্পানির রড এক লাখ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে নির্মাণকাজ আগের চেয়ে বেড়েছে। ১০-১৫ দিন আগেও বুকিং দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না রড। সামনে রডের দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানান তারা। গত বুধবার বিকেলে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের রড প্রতি টন এক লাখ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে একেএস ও জিপিএইচ ইস্পাতের রডের দামও কাছাকাছি। শুধু কেএসআরএমের রড বিক্রি হচ্ছে ৯৮ হাজার টাকায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ডলারের সংকট রয়েছে। চাইলেই স্ক্র্যাপ আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং রেট বেড়ে গেছে। পাশাপাশি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে জাহাজভাড়াও। এতে স্ক্র্যাপের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, যা রড উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। ফলে বাজারে বাড়ছে রডের দাম।
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রডের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে উৎপাদকেরা জানিয়েছেন। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি মূল্য পরিশোধ, তুরস্কের ভূমিকম্পের পর বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম আরেক দফা বৃদ্ধির কারণে রডের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে গ্যাসবিদ্যুৎ ও ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধে এসে পড়েছে।
শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, রড উৎপাদনে খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তা সমন্বয় করা হয়েছে। শুধু জাহাজভাঙা শিল্পের স্ক্র্যাপ (পুরোনো লোহার টুকরো) ব্যবহার করে রড উৎপাদন করলে এখন খরচ পড়বে ন্যূনতম ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। লাখ টাকা ছাড়ানো শীর্ষ সারির প্রথম তিনটি ব্র্যান্ড হলো বিএসআরএম, আবুল খায়ের স্টিল ও জিপিএইচ ইস্পাত। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দাম জিপিএইচ ইস্পাতের রডের। খুচরায় তাদের রডের টনপ্রতি সর্বোচ্চ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫০০ টাকা। বিএসআরএম ও আবুল খায়ের স্টিলের রডের দাম ১ লাখ টাকায় থেমেছে। এ ছাড়া বুধবার দাম বাড়ানোর পর কেএসআরএম ব্র্যান্ডের রড ৯৮ হাজার টাকা এবং এইচএম স্টিল ব্র্যান্ডের রড ৯৬ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
দাম বাড়ার এ প্রবণতা শুরু হয়েছে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। কোম্পানিগুলোর নীতি হলো, তারা এক লাফে রডের দাম খুব বেশি বাড়ায় না। সাধারণত একবারে টনপ্রতি রডের দাম ৫০০ টাকা বাড়ায় তারা। যেমন এ সপ্তাহে সোমবার টনপ্রতি ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এরপর গত বুধবারও বাড়ানো হয়েছে ৫০০ টাকা। রডের কাঁচামালের আরেক উৎস পুরোনো জাহাজের দামও আবার বাড়তে শুরু করেছে। গ্রিসভিত্তিক ইন্টারমোডাল শিপব্রোকার্সের গত সপ্তাহের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পমালিকেরা তিনটি জাহাজ কিনেছেন। এই তিনটি জাহাজের টনপ্রতি লোহার দর পড়েছে ৫৬০ ডলার, ৫৮৫ ডলার ও ৬১৬ ডলার। গত ডিসেম্বরে পুরোনো জাহাজের টনপ্রতি দাম ৫০৫ ডলারে নেমেছিল।
কোম্পানিগুলো বলছে, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং কাঁচামালের অভাবে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন চালানো যাচ্ছে না। তাতে খরচ বাড়ার বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এ জন্য প্রস্তুত পণ্যের দাম বাড়ানো ছাড়া উৎপাদকদের কাছে বিকল্প পথ খোলা নেই। উল্লেখ্য, এক বছরের ব্যবধানে মিলগেটে ভালো মানের বা ৬০ গ্রেডের এক টন রডের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে কোম্পানিভেদে প্রতি টন রড খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয়েছিল ৭১ থেকে ৭৮ হাজার টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ টাকার বেশি দামে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ছিল প্রতি টন ৬৬ হাজার থেকে ৬৮ হাজার টাকা।