১৬ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১:১০

রেলের ২০০ বগি ক্রয়

দরপত্রের শর্ত নিয়ে প্রশ্ন

আগামী দুই বছরে রেলের বহরে যাত্রীবাহী ২০০ ব্রড গেজ ক্যারেজ (বগি) যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব বগি সংগ্রহে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে রেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান পিটি ইনকাকে সুবিধা দিতে দরপত্রে বিশেষ কিছু শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।

গত ৩০ জানুয়ারি শুরু হওয়া দরপত্র জমা দেওয়ার সময় রয়েছে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সময় বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে দরপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্তে পরিবর্তন আনা হতে পারে।

দরপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ বছরে অন্তত ৮০০ বগি তৈরি করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারবে। অথচ আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে পাঁচ বছর। দরপত্রে বলা হয়, ‘রেলওয়ের যন্ত্রপাতি ও এসংক্রান্ত সেবা প্রদানের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রধান সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সফলতার সঙ্গে গত ১৫ বছরে ৬০ মিলিয়ন ডলারের কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অন্তত একটি কাজের সর্বনিম্ন মূল্য হতে হবে ২০ মিলিয়ন ডলার।’

গত ২ মার্চ রাজধানীর রেল ভবনে এসংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সম্ভাব্য দরপত্র আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ৮০০ বগি দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বৈঠকে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা কেন এক হাজার বগির নয়? এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইন্দোনেশীয় প্রতিষ্ঠান পিটি ইনকাকে সুবিধা দিতেই এই শর্ত দরপত্রে যুক্ত করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, দরপত্রের শর্ত এরই মধ্যে একবার বদল করা হয়েছে। এর আগে শর্ত ছিল, ঠিকাদারদের এমন বগি দিতে হবে, যেটা ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। সেই শর্ত পরিবর্তন করে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে এমন বগি চাওয়া হয়েছে। কারণ পিটি ইনকা ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে এমন বগি সরবরাহ করতে পারবে না।

প্রকল্প সূত্র বলছে, ২০১৯ সালে ‘২০০টি ব্রড গেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় রেলওয়ে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি)। তাঁদের সঙ্গে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। চুক্তির টাকা সরাসরি ঠিকাদারকে দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জয়দুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দরপত্র চলমান রয়েছে। এখন কিছুই বলতে পারব না। বললে আইনের ভায়লেশন হবে।’

এদিকে ২০১৭ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ২০০ মিটার গেজ বগি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। তখন দরপত্রে দেড় হাজার বগি সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত ছিল। কিন্তু পিটি ইনকা সেই শর্তপূরণ করতে না পারায় দরপত্রের শর্ত সংশোধন করে ৫০০ বগি সরবরাহের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়। এখন পিটি ইনকার ৮০০ বগি সরবরাহের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই শর্তে ৮০০ বগির কথা বলা হয়েছে।

রেলের সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান ২০১১ সালে যুগ্ম মহাপরিচালকের (রোলিং স্টক) দায়িত্বে ছিলেন। তখন পিটি ইনকার কাছ থেকে ১০০টি মিটার গেজ এবং ৫০টি ব্রড গেজ কোচ কেনা হয়। সেই প্রকল্পের পরিচালকও ছিলেন তিনি। ওই প্রকল্পে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করছে।

দুদকের নথিতে বলা হয়, ২০১৭ সালে ৫৭৯ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় ইন্দোনেশিয়া থেকে মিটার গেজ কোচ সংগ্রহ করে রেল। পছন্দের কম্পানিকে কাজ দিতে এসব কোচ কেনার দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন করা হয়েছে।

২০১১ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান পিটি ইনকা বাংলাদেশ রেলওয়েতে তিনবারে মোট ৪৫০টি বগি সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ১৫০টি ব্রড গেজ এবং ৩০০টি মিটার গেজ।

পিটি ইনকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি আফসার বিশ্বাস। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য না মিথ্যা আমি কিছু বলব না। আপনারা খুঁজে বের করেন। এটা ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার। এটা আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না। মন্ত্রী আছেন, ডিজি আছেন, সচিব আছে—তাঁদের জিজ্ঞেস করেন।’

পিটি ইনকার সরবরাহ করা অন্য বগিগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন খোঁজ নিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে রাজি হননি। রেলমন্ত্রী সুজনের মোবাইলে ফোন করা হলে প্রশ্নটি শুনে তিনি বলেন, ‘এখন প্লেনে উঠছি, কথা বলা সম্ভব নয়।’
এদিকে রেলের কোচে বিভিন্ন সময় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পিটি ইনকার সরবরাহ করা কোচগুলোর ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এসব বগির অগ্নি প্রতিরোধ সক্ষমতা অনেক দুর্বল ছিল। তবে তখনকার দরপত্রে অগ্নি প্রতিরোধ সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। এবারই প্রথম অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দরপত্রে যুক্ত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব কিছু মিলিয়ে যে অভিযোগ উঠছে সেটা একেবারে মিথ্যা নয়। এই বিষয়গুলো আমাদের নজরে আসছে। তাই আবারও দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হতে পারে।

ইন্দোনেশিয়ার একটা প্রতিষ্ঠান যেন বেশি সুবিধা না পায় সে বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। আশা করছি, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভারত ও চীনের বেশ প্রতিযোগিতা হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/16/1261529