১৫ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ১২:২০

তিস্তার পানি সরাতে ভারতের আরো দুটি খাল কাটার উদ্যোগ ॥ বাংলাদেশের বিপর্যয় বাড়বে

তিস্তার উজানে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে এখনই রয়েছে ক্যানেলসহ ৪২টি প্রকল্প। সেখানে আরো দুটি খাল কেটে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর ফলে নতুন করে বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশের তিস্তাকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবনজীবিকা।

সাম্প্রতিক খবরে জানা গেছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় আরো দুটি খাল খননের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিভাগ প্রায় এক হাজার একর পরিমাণ জমির মালিকানা পেয়েছে। ইতোমধ্যে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন জমির মালিকানা হস্তান্তর করেছে। ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পদক্ষেপের আওতায় জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার এলাকার আরো অনেক কৃষিজমি সেচের আওতায় আসবে। তিস্তা প্রকল্পে নতুন খাল খননের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করবে। এতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কম পানি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলপাইগুড়ির জেলা প্রশাসন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে সেচ বিভাগকে জমির মালিকানা হস্তান্তর করে। এ জমির মাধ্যমে তিস্তার পূর্ব তীরে দুটি খাল তৈরি করতে পারবে প্রশাসন। জলপাইগুড়ি জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া আরেক নদী জলঢাকার পানিপ্রবাহও খালের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হবে।

প্রকল্প-পরিচয় : পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের এক সূত্রের বরাতে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিস্তা ও জলঢাকার পানি টানার জন্য কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করা হবে। আরেকটি খালের দৈর্ঘ হবে ১৫ কিলোমিটার। এটি তিস্তার বাম পাশের তীরবর্তী এলাকায় খনন করা হবে। খাল খনন করা হলে প্রায় এক লাখ কৃষক সেচসুবিধার আওতায় আসবে। ব্যারাজটি জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী বলেন, ‘খাল খননের জন্য জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন আমাদের কাছে এক হাজার একর জমি হস্তান্তর করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার একে জাতীয় প্রকল্প (২০০৯ সালে) ঘোষণা করলেও তহবিল দিচ্ছে না। তবে তহবিল না পেলেও আমরা ধাপে ধাপে কাজ (খালের নেটওয়ার্ক তৈরি) শেষ করার চেষ্টা করবো।’ টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ বছর পর তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে এ খাল খননের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করবে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি এখনো সই হয়নি। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেচ নেটওয়ার্কের আওতা বাড়াচ্ছে। এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে নতুন খালের মধ্য দিয়ে তিস্তা নদী থেকে আরো বেশি পানি সরিয়ে নেয়া হবে। এর মানে, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ আরো কম পানি পাবে।”

বর্তমানে বিদ্যমান বাঁধ-খাল : বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধায় তিস্তা ব্যারেজের ১০০ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গাজলডোবায় তিস্তা নদীর ওপর একটি বহুমুখি বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ১৯৭৫ সালে ওই প্রকল্প শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর আওতায় দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার জেলা, বিহারের পুর্ণিয়া ও আসামের কিছু এলাকার ৯০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ২২.৫ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তিস্তা বহুমুখি বাঁধ থেকে ভারত গজলডোবা ব্যারেজের বামে তিস্তা-জলঢাকা প্রধান খাল, ডানে তিস্তা-মহানন্দা খাল, মহানন্দা প্রধান খাল, ডাউক-নাগর প্রধান খাল ও নাগর-টাঙ্গন প্রধান খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

তিস্তার পানি মহানন্দায় : শুধু গাজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোই শেষ নয়, উজানে খাল কেটে ‘তিস্তা-মহানন্দা ক্যানেল’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তার পানি মহানন্দায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর দৈর্ঘ ২৫ কিলোমিটার। আর মহানন্দায় একটি ব্যারেজ প্রকল্পের সাহায্যে এই বাড়তি পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। গাজলডোবায় যে ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে তার ফলে তিস্তার ভারতীয় অংশ শুকনো মওসুমে পানির আধারে পরিণত হয়। এই আধার থেকে পানি সরিয়ে নেবার জন্য তৈরি ‘তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল’-এর সাহায্যে তিস্তার শুকনো মওসুমের প্রবাহ থেকে ১,৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ খালটির মধ্যে করলা, নিম, সাহু, করতোয়া ও জোড়াপানি নদী রয়েছে। এসব নদীর ওপর অ্যাকুইডাক্ট (কৃত্রিম পানিপ্রণালী) তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক কারিগরিতে তৈরি অ্যাকুইডাক্টের নিচে বয়ে চলেছে নদী, ওপর দিয়ে খাল। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি রুপি।

বাংলাদেশের একপাশে (বাংলাদেশ থেকে ৬৩ কি. মি. উজানে) ১৯৭৫-৭৬ সালে তিস্তায় তৈরি করা হয়েছে ৯২১.৫৩ মিটার দীর্ঘ তিস্তা ব্যারেজ এবং অন্যপাশে বাংলাবান্ধার অদূরে মহানন্দায় ১৯৮৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে মহানন্দা ব্যারেজ। মহানন্দা ব্যারেজে লকগেট রয়েছে ১০টি। এই দুই ব্যারেজের মধ্যবর্তী স্থানের হাজার হাজার একর জমিকে সুজলা-সুফলা করতে তিস্তার প্রায় সমুদয় পানি প্রবাহ কাজে লাগানো হচ্ছে। এজন্য আরো একাধিক শাখা-প্রশাখাযুক্ত খাল খনন করা হয়েছে। এই ব্যারেজ ও খালের মাধ্যমে ভারত তিস্তার মোট পানি প্রবাহের ৮০ শতাংশ পানি জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও কোচবিহার জেলার ব্যাপক কৃষি জমিতে সেচ প্রদান করছে। উদ্বৃত্ত ২০ শতাংশ পানি ভারত ভাটিতে ছাড়লেও ৬৩ কি. মি. পথ অতিক্রম করে এই ¯্রােতধারা বাংলাদেশের ব্যারেজ এলাকায় পৌঁছাতে গিয়ে একেবারেই ক্ষীণ দশায় পরিণত হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, আরো উজানে সিকিমে তিস্তার উপর অনেকগুলো হাইড্রোইলেকট্রিক প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর ফলে তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আর পশ্চিমবঙ্গের খালগুলো দিয়ে তিস্তার পানি তাদের অভ্যন্তরীণ সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে বাংলাদেশে তিস্তার পানির পরিমাণ কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয় বলে পর্যবেক্ষকরা হতাশা প্রকাশ করেন।

তিস্তা ক্যানেল পাওয়ার হাউজ : ভারত তিস্তা ক্যানেল পাওয়ার হাউজ নামে তিন স্তরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে তিস্তা মিলিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে এবং তিস্তার পানি ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রবাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। এই শিলিগুড়ির কাছে তৈরি ক্যানেল মহানন্দা ব্যারেজে মিলিত হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন তিস্তার পানি মহানন্দায় নেয়া যাচ্ছে, আবার এই ক্যানেলের উপর পাওয়ার হাউজও নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো মহানন্দা ব্যারেজ থেকে ৫ কি.মি, ২১ কি.মি ও ৩১ কি.মি পর পর তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি পাওয়ার হাউজ থেকে ৭.৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ১৯৯৭-৯৯ মেয়াদে এসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের কারণে একাধারে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তিস্তার প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেতিস্তার পানি কাজে লাগানোর মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য ভারত বিভিন্ন স্তরে কয়েকটি ভাগে প্রকল্প গ্রহণ করে। এগুলো হলো, তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল, মহানন্দা মূল ক্যানেল, ডাউক-নাগর মূল ক্যানেল এবং নগর টাঙ্গন মূল ক্যানেল। সম্পূর্ণ প্রকল্পটির নির্মাণ শেষ হলে সেচের আওতায় আসবে প্রায় ৯,২৫,০০০ হেক্টর জমি। কিন্তু পুরো প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা বাস্তব কারণে তা আর বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এমনকি মূল ক্যানেল নিয়েই সমস্যা রয়ে গেছে। এ সমস্যার কারণে পুরো ব্যবস্থাটি অকার্যকর হয়ে আছে। ফলে এই প্রকল্প অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমিয়ে রাখা পানির অপচয় ঘটছে। আর বাংলাদেশ অংশ পরিণত হচ্ছে পানিহীন শুষ্ক ভূমিতে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশকে পানির হিস্যা দিতে হলে এসব খাল বন্ধ করে দিয়ে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। ভারতের গজলডোবা থেকে বাংলাদেশের ডালিয়া পর্যন্ত তিস্তা নদীর ৬৩ কিলোমিটার অংশকে নাব্য রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : এবিষয়ে নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সভাপতি এডভোকেট এনামুল হক বলেন, এমনিতেই তিস্তার উপর অসংখ্য প্রকল্প, বাঁধ ও খাল তৈরি করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে এবং এর ফলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত করছে। নতুন করে খাল কাটা হলে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প একেবারে অকেজো হয়ে পড়বে এবং ঐ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া আরো তরান্বিত হবে। তিনি বলেন, বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এই খাল কাটার পরিকল্পনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিরবতা পালন করে চলেছে। তিনি এব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবি করেন।

https://dailysangram.com/post/519316