১৫ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ১২:১৭

ফুলপরীরা জেগে উঠলেই দেশ জেগে উঠবে

-মো: হারুন-অর-রশিদ

আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে নারীরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, রেখেছে বিপ্লবী ভূমিকা, এমন ইতিহাস কম নেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম কে না জানে! ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে শহীদ হন। ভারত উপমহাদেশের সংগ্রামী নারী সমাজে প্রীতিলতা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন। আরেক বিপ্লবী নারী নেত্রী আভা দেবী ছিলেন ভারতবর্ষে ইংরেজ আইন অমান্য আন্দোলনের নারীশক্তিদের একজন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের নারী বিপ্লবী। ইলা মিত্র একজন বাঙালি মহীয়সী নারী ও সংগ্রামী কৃষক নেতা। তিনি মূলত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। এভাবে শত শত নারী আছেন যারা বিপ্লবী ভূমিকা রেখে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা নারী তারামন বিবি, সেতারা বেগম, কাঁকন বিবিসহ অসংখ্য নারীদের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। নারীরা জেগে উঠলেই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা সহজ হয়। এরশাদের স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব এই দেশের রাজনীতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি কখনোই অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। আপস করেননি কোনো স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে। রাষ্ট্র আজ ভূলুণ্ঠিত। ১৯৯১ সালে পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী শাসকের দ্বারা পুরো লুণ্ঠিত। গণতন্ত্রহীন এই রাষ্ট্রে একজন শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে পড়াশোনার সুযোগও নেই। তাদের ওপরও চলে কর্তৃত্ববাদী সরকারের লালিত পালিত গুণ্ডা বাহিনীর নির্দয় তাণ্ডব।

বিশ^বিদ্যালয় একজন ছাত্রের কাছে স্বপ্নের জায়গা। প্রথমে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা যেমন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায় তেমনি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন মনের মধ্যে জেঁকে বসে। গ্রামের একজন অতিসাধারণ পরিবারের সন্তানের সেই স্বপ্ন যখন কিছু দুষ্কৃতকারী, বখে যাওয়া নষ্ট ছাত্রছাত্রীর হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তার সামনের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। কেউ রুখে দাঁড়ায়, কেউ মানসিক পীড়ায় ভুগতে থাকে। গ্রামের একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান ফুলপরী অনেক স্বপ্ন নিয়েই ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু অঙ্কুরেই তার সব স্বপ্ন নষ্ট রাজনীতির ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে। তবে সে হার মানেনি। প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নষ্ট রাজনীতির বখে যাওয়া ছাত্রীদের নিষ্ঠুর আচরণ তাকে বিদ্ধ করেছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের গণরুমে। সেই রাতে ফুলপরীকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য- বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।’

ফুলপরী স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করবে, এটিই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু সেই বাস্তবতা আজ ভূলুণ্ঠিত হয়ে দৌড়াতে হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে হচ্ছে তদন্ত কমিটির কাছে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ক্যাম্পাসে করতে হচ্ছে পুলিশ মোতায়েন। মুখোমুখি হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। একটি স্বাভাবিক জীবন কতটাই না অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে ফুলপরীর কাছে। এভাবে প্রতিনিয়ত কত শত ছাত্রছাত্রীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে না। ফুলপরী প্রতিবাদী হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তবুও তার এবং তার পরিবারের মনে বিচার না পাওয়ার শঙ্কা ভর করেছে।

গ্রামের দরিদ্র, অতি দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অনেক কষ্ট করে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অনেক সময় পরিবার থেকে পড়াশোনার খরচও বহন করা সম্ভব হয় না। চলতে হয় টিউশন করে। ফুলপরীও তার ব্যতিক্রম নয়। কঠিন সংগ্রাম করে সংসারের অভাব-অনটনের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বড় করছেন ফুলপরীর মা তাসলিমা খাতুন। পরিবারের একমাত্র উপার্জন আসে ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক আতাউর রহমানের আয়ে। নিজেরা কখনো প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় পা রাখেননি। তার মায়ের ভাষায়, ‘আমরা কষ্ট করেছি, কিন্তু ছেলেমেয়েরা যাতে কষ্ট না করে, সে জন্য তাদের লেখাপড়া শেখানো। কত ঝড়-তুফান আসছে, কিন্তু পিছপা হইনি। তারা শিক্ষা নিয়ে চাকরি করবে, সংসারের অভাব দূর করবে।’ কিন্তু ফুলপরীর মায়েরা এই কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন, তা ছাত্রলীগের নষ্ট রাজনীতির ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত।

বিশ^বিদ্যালয় হচ্ছে সভ্যতার পাদপীঠ। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা হয় অন্যদের দৃষ্টান্ত। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী গ্রাম থেকেই আসে। রাজনীতির সাথে তাদের পূর্বপরিচয় না থাকলেও বিশ^বিদ্যালয় হলে উঠার পর থেকে রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে হয়। কেউ রাজনীতি পছন্দ না করলেও হলে থাকার জন্য রাজনীতির মিছিলে যেতে হয়, এটি প্রায় স্বাভাবিক নিয়ম। গ্রাম থেকে উঠে আসা সহজ-সরল ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথমেই র‌্যাগিং নামের অপসংস্কৃতিতে তাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। হলজীবনের প্রথমেই একজন নবীন ছাত্রকে থাকতে হয় গণরুমে। গণরুমে থাকার জন্যই প্রথমে আদব-কায়দা শেখানোর নামে তাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়। গণরুমে থাকার জন্য একজন নবীন শিক্ষার্থীর ওপর কী আচরণ করা হয়, হলের টিউটর বা প্রভোস্টের কাছে বলার সাহস পায় না; বরং এসব শিক্ষার্থীকে ক্ষমতাবানরা সতর্ক করে দেন কারো কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ না করতে। এরপর কার কলিজার এত পাটা যে, ‘অত্যাচারীদের’ বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেয়? ফুলপরী সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছে। সাহসের সাথে তা মোকাবেলাও করছে। সে সব ডরভয় উপেক্ষা করে মুখ খুলেছে, প্রতিবাদী হয়েছে। তার প্রতিবাদে অনেক ছাত্রই কিছুটা হলেও প্রতিবাদী হওয়ার সাহস দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যে ফুলপরীর প্রতিবাদের আওয়াজ আদালত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটিও তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রীকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।

ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে যেমন সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, তেমনি কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীও অতিষ্ঠ। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে তারা রামরাজত্ব কায়েম করেছে। দল থেকেও তাদের অপরাধের দায়মুক্তি মিলছে, তেমনি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও করতে হয় না কোনো অপরাধের জবাবদিহি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোতে উঠতে হলে আগে হল ছাত্রলীগের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি ছাড়া হলে ওঠলে কী ভয়ঙ্কর সাজার মুখোমুখি হতে হয় তার বাস্তব দৃষ্টান্ত হলো ফুলপরী। তার ওপর হয় রাতভর নানাভাবে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন। সেই সাথে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ। হল ত্যাগ না করলে আবার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি। এত কিছুর পরও কি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল? না, কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ একজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকও ছাত্রলীগের কাছে নিজেদের আত্মমর্যাদাকে এক ধরনের বিকিয়েই দিয়েছেন। তা না হলে একজন নিরীহ ছাত্রীকে রাতভর নানাভাবে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা আদিম কায়দায় নির্যাতন করল অথচ শিক্ষক হয়ে তারা এই অসহায় মেয়েটিকে রক্ষা করার ন্যূনতম ব্যবস্থা নিতে পারলেন না! তারা কেমন শিক্ষক? কি তাদের আত্মসম্মান বোধ? কি-ই বা তাদের নৈতিকতা? এর আগেও বুয়েটে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই সারারাত নির্যাতন করে হত্যা করেছিল আবরার ফাহাদকে, সেদিনও বুয়েটের শিক্ষকরা ছিলেন নীরব দর্শক। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন, শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ ছাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়? কে নেবে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব?

সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের অনেকটাই অন্তরায় বর্তমান সময়ের ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ড। ফুলপরী আজ তার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কিছু সময়ের জন্য হলেও সমাজ তথা রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিয়েছে, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অগণিত মানুষের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে আজ কী হচ্ছে! ফুলপরী দেখিয়ে দিয়েছে, অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয় না, প্রতিবাদ করতে হয়। অথচ আমরা যাদেরকে সমাজের বিবেক হিসেবে জানি বা মানি তারা কি পারছে সমাজ তথা রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের কার্যকর প্রতিবাদ করতে? নাকি তারা নিজেদের ব্যক্তি সুবিধা হাসিলের জন্য নিজেদের বিবেক-বুদ্ধিকে বিসর্জন দিচ্ছে? দেশে আজ গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই, স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা নেই। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের ইচ্ছামতো তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কিন্তু কোনো মানুষের আওয়াজ নেই। রাজপথে প্রতিবাদ নেই। এমন একটি গুমোট পরিস্থিতিতেও ফুলপরী তার ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। সরকারের এত এত অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ মানুষের মুখে তার এই প্রতিবাদ এক ধরনের চপেটাঘাত। এটি প্রমাণিত সত্য, ফুলপরীর মতো সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে জাতি জেগে উঠবে। মুক্তি পাবে এই দেশের মানুষ। অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে সংবিধানের আলোকে। তবে সত্য হলো, সবাইকে জাগতে হবে।

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/734252