২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭

হার্টে রিং পরাতেও ধর্মঘটের বাধা

নির্ধারিত রোগীদের এনজিওগ্রাম করা শেষ, যাদের হৃদযন্ত্রে ব্লক ধরা পড়েছে তাদের রিং (করোনারি স্টেন্ট) পরাতে হবে। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল, হাসপাতালে রিং পাওয়া যাচ্ছে না। আতঙ্ক ভর করে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে। উদ্বেগ ছড়ায় চিকিৎসকদের মধ্যেও। শেষ পর্যন্ত রিং না পরিয়েই ক্যাথল্যাবের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থেকে বের করতে হয় হৃদরোগে আক্রান্ত একেকজন রোগীকে। রিং ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের কারণে গতকাল বুধবার অমানবিক এ ঘটনা ঘটেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।

হৃদরোগীদের হার্টের রিং নিয়ে নৈরাজ্য কমাতে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই প্রতিবাদে রিং ব্যবসায়ীরা এ ধর্মঘট শুরু করেছে। কেবল ঢাকায়ই নয়, ধর্মঘটের কারণে গতকাল সারা দেশে চার শতাধিক রোগী জিম্মি হয়ে পড়ে রিং বিক্রেতাদের কাছে। রিং না পরানোর কারণে এসব রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। তাদের মধ্যে অনেককে এখন আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে নতুন করে শিডিউল পেতে। ফলে বাড়বে খরচ, সঙ্গে ভোগান্তি।
এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলায় ঘাতক বাসের চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাভারে এক নারীকে ট্রাকচাপায় হত্যার দায়ে ট্রাকচালকের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। এর প্রতিবাদে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে ৩৯ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে পরিবহন শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলো। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় দেশের মানুষকে। সর্বশেষ গত রবিবার থেকে রাজধানীতে বাসের সিটিং সার্ভিস বন্ধে বিআরটিএ অভিযান শুরু করলে পরিবহন মালিকদের একটি বড় অংশ রাস্তায় বাস না নামিয়ে কার্যত ধর্মঘট পালন করে। চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ যাত্রীরা। এর ফলে আগামী ১৫ দিন এই অভিযান স্থগিত রাখা হবে বলে গতকাল ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় বিআরটিএ। এ ছাড়া বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর স্বজনদের মারধর করায় চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের শাস্তির ঘোষণা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর প্রতিবাদে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে বগুড়াসহ দেশজুড়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেন। এতে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়ে রোগীরা। পাঁচ দিন পর রোগীদের কথা বিবেচনা করে ইন্টার্নদের শাস্তি মওকুফ করে ধর্মঘট থেকে তাঁদের কাজে ফেরান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এভাবেই দাবি আদায়ে বিভিন্ন সময় জিম্মি করা হয়েছে সাধারণ জনগণকে। এখন হার্টের রিং বাণিজ্য নিয়ে চলছে ধর্মঘট।
এনজিওগ্রাম শেষে রিং পরানো দরকার ছিল—এমন এক রোগীর স্বজন আজিজুল গতকাল হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার রোগীর অবস্থা এমনিতেই খারাপ ছিল। এনজিওগ্রাম শেষে কার্ডিওলজির ডাক্তার ওটির বাইরে এসে জানান, দুটি রিং পরাতে হবে, দ্রুত রিংয়ের ব্যবস্থা করেন। এ সময় আমরা রিংয়ের খোঁজে ছোটাছুটি করতে থাকি। ডাক্তার বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের ক্যাথল্যাবের নির্ধারিত কক্ষে থাকা কর্মীরা জানান, রিং বিক্রেতারা ধর্মঘট ডেকেছে, কেউ রিং বিক্রি করবে না। এ কথা শুনে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমরা কান্নাকাটি শুরু করি। তবে কোনো উপায় করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারকে বিষয়টি বলার পরে তিনি রোগীকে ওটি থেকে বের আনেন। বলে দিয়েছেন রিং পাওয়া সাপেক্ষে পরে রিং পরানো হবে। ’
গুরুতর আরেক রোগীর স্বজন বলেন, ‘রিং না পেয়ে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সবখানেই একই অবস্থা। শেষ পর্যন্ত রোগীকে আবার হাসপাতালের বেডে নিয়ে যেতে হয়েছে। এখন আল্লাহই জানে কী হয় না হয়!’
এ হাসপাতাল ছাড়াও গতকাল ঢাকার অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় একইভাবে ভোগান্তির শিকার হয় হৃদরোগীরা।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ (বুধবার) আমার পূর্বনির্ধারিত ১৪ জন রোগী ছিল এনজিওগ্রামের। তাদের মধ্যে ছয়জনের রিং প্রয়োজন ছিল। কিন্তু না পাওয়ায় তাদের রিং পরাতে পারিনি। তাদের হাসপাতালের বেডে পাঠাতে হয়েছে। রিং পেলে আরেক দিন তা পরিয়ে দিতে হবে। এর মধ্যে কোনো কোনো রোগী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ’ ধর্মঘটের বিষয়ে তিনি বলেন, রোগীদের জিম্মি করে রিং বিক্রেতাদের এই ধর্মঘট খুবই অমানবিক ও অন্যায় হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক এবং বাংলাদেশ কার্ডিওলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত অর্থবছরে আমরা সরকারিভাবে রিং কিনেছিলাম, যা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এবার আবার নতুন করে রিং কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর এই গ্যাপে রোগীদের স্বার্থেই বাইরের প্রাইভেট রিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা হাসপাতালে রিংসহ অবস্থান নিয়ে থাকে। যখন যে রিং দরকার হয় চিকিৎসকের পরামর্শে ও রোগীর পছন্দ অনুযায়ী তারা সেই রিং সরবরাহ করে থাকে। এতে রোগীকে এনজিওগ্রামের টেবিলে রেখে রোগীর স্বজনকে রিং সংগ্রহের জন্য হাসপাতালের বাইরে ছুটতে হয় না। কিন্তু রিং বিক্রি বন্ধ করে ধর্মঘট করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। তবে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বৃহস্পতিবার (আজ) তারা রিং বিক্রি করবে। রোগীদের আর সমস্যা হবে না। ’
ওই হাসপাতালে যখন রোগীদের জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা রিং বিক্রি বন্ধ করে রেখেছিল, ঠিক তখনই সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে রিংয়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একটি সভা চলছিল। সভায় সব রিংয়ের প্যাকেটের গায়ে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য ছাপানো বাধ্যতামূলক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বছরে প্রায় ১৮ হাজার হার্টের রিং পরানো হয় হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষের হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে। আর এই রিং নিয়ে নৈরাজ্যে মেতে ওঠে ব্যবসায়ীচক্র ও কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। রোগীদের কাছ থেকে একই রিংয়ের দাম একেক জায়গায় একেক হারে আদায় করা হয়। ফলে রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হয়রানির শিকার হয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রোগীদের এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন পরে হলেও উদ্যোগ নিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা রিংয়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমদানিকারকদের সার্বিক লভ্যাংশ নিশ্চিত করেই সরকার নির্ধারিত দাম রাখতে হবে রোগীদের কাছ থেকে। হাসপাতালের দর্শনীয় স্থানে ঝোলানো থাকতে হবে সরকার নির্ধারিত মূল্যতালিকা। কোথাও ওই তালিকার বেশি দাম নিলেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
ধর্মঘটের বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রাতে করোনারি ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা গাজী শাহীনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি ফোনই ধরেননি। পরে ফোনটি বন্ধ করে দেন।
গত মঙ্গলবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ে রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। মহাখালীর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গত ১১ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বৈঠকে হার্টের স্টেন্ট বা রিংয়ের মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেগুলো এখন কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে।
ব্রিফিংয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই আমরা খবর পাই ২৫ বা ৫০ হাজার টাকার রিংয়ের দাম কোথাও কোথাও রোগীদের কাছ থেকে এক-দেড় লাখ টাকা করে আদায় করা হয়। এটা খুবই অন্যায়। আবার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। এসব কারণেই বিশেষ কমিটি গঠন করে দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই যার সুফল আসতে শুরু করেছে। চারটি অনুমোদিত আমদানিকারক কম্পানি ঔষধ প্রশাসনের কাছ থেকে তাদের প্রতিটি মেডিকেটেড রিংয়ের দাম ৫০ হাজার ও নন-মেডিকেটেড রিং ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার আবেদন করেছে। ফলে ওই চার প্রতিষ্ঠানের রিংয়ের প্যাকেটের গায়ে খুচরা মূল্য হিসেবে ওই দাম উল্লেখ করে দেওয়া হবে। তবে বাকি ১৭টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এখনো তাদের রিংয়ের দাম নির্ধারণে কোনো আবেদন করেনি। ’
মহাপরিচালক আরো জানান, দেশে এখনো কোনো রিং তৈরি হয় না। ফলে সবই আমদানিনির্ভর। এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত মোট ২১টি প্রতিষ্ঠান ৪৭ ধরনের করোনারি স্টেন্টের (রিং) রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের আরো জবাব দেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রুহুল আমিনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা।
এ সময় জানানো হয়, ভারতে যে রিংয়ের দাম সাত হাজার ২৬০ রুপি, তা বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করলে হয় আট হাজার ৯২৯ টাকা। আর যে রিংয়ের দাম ভারতে ২৯ হাজার ৬০০ রুপি, তা বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করলে হয় ৩৬ হাজার ৪০৮ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশে ওই রিংয়ের দাম দীর্ঘদিন ধরেই আদায় করা হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। যে যার মতো ইচ্ছানুসারে রিংয়ের দাম রাখছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/20/488722