১৪ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:০৯

জনপ্রতি মাসে পরামর্শক খরচ ৩৬ লাখ টাকা

বর্তমানে আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কাস্টমসের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা ক্রমবর্ধমান সেবা গ্রহণের চাহিদার সাথে তাল মিলাতে সক্ষম হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, এ অঞ্চলের বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সমস্যা, দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা, কাস্টমস হাউজগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি বড় সমস্যা। বাংলাদেশের কাস্টমসের আধুনিকায়নে শুধু ভবন নির্মাণের এই প্রকল্পে পরামর্শক খাতে প্রতি মাসে খরচ হবে ৩৬ লাখ টাকার বেশি। এই খাতে মোট ব্যয় প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকা। আর আপ্যায়ন ব্যয় ৪৮ মাসে ৪০ লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে গাড়ি ভাড়া ৩ লাখ টাকা বলে প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে।

অর্থ বিভাগের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল আঞ্চলিক বাণিজ্য বা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এ দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০৫ সালের ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০১৯ সালে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও এদের সক্ষমতার তুলনায় তা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ অঞ্চলের বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সমস্যা, দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা, কাস্টমস হাউজগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছে।

সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এগিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশে আঞ্চলিক পরিবহন ও বাণিজ্য সুবিধা কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ, কাস্টম হাউজ, বেনাপোল এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ট্রেনিং একাডেমি, চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্পটি। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৮৬ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। যার মধ্যে বিশ^ব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা (আইডা) থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে এক হাজার ৪৭৫ কোটি ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ২১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। চার বছরে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাস্টমসের উন্নয়ন ও আধুনিকান করা হবে বলে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, ঢাকা কাস্টমস হাউজে প্রতিদিন সাড়ে ৩ হাজার ডিক্লারেশন হয়। ১০ হাজার জন সেবাগ্রহীতা সেবা নিতে আসেন। এ ছাড়া ঢাকা বিমানবন্দরের মাধ্যমে বিদ্যমান কার্গোর কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়, যেখানে প্রতিদিন দুই শ’ থেকে আড়াই হাজার ডিক্লারেশন সম্পন্ন করা হয়। গত ২০১৯-২০২০ সালে এই বন্দর দিয়ে আমদানি ও রফতানি উভয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টার্মিনাল-৩ চালু হওয়ার পর আশা করা যাচ্ছে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঢাকা কাস্টমস হাউজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক।

বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল সংলগ্ন ভারতের পেট্রাপোলের সক্ষমতার বিপরীতে বন্দরটির প্রতিদিন ৭৫০ ট্রাকের ক্লিয়ারেন্সের সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। যেখানে বর্তমানে এর মাত্র ৩৫০টি ট্রাকের ক্লিয়ারেন্সের সক্ষমতা রয়েছে। বন্দরটি প্রতিদিন ১২ হাজার জন যাত্রীর ইমিগ্রেশন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসেবে, রেল কার্গোর পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই বন্দরের মাধ্যমে আমদানি ছিল ২ বিলিয়ন ডলার এবং রফতানি ছিল দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। দিন দিন এই বাণিজ্য বাড়ছে। বেনাপোল বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একাডেমিতে বছরে শুধু এক শ’ জন কর্মকর্তাকে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে সক্ষম। একাডেমিক, আবাসিক ও আধুনিক ল্যাব সুবিধা না থাকার ফলে এখানে অন্য কোনো প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাস্টমসের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বছরব্যাপী তিন থেকে পাঁচ শ’ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ একাডেমিটিকে বিশ্বমানের উপযোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এ প্রকল্পের আওতায় মূল কাজগুলো হলো, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও ভ্যাট প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের আবাসিক ভবনাদি নির্মাণ, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও ভ্যাট প্রশিক্ষণ একাডেমির আবাসিক ভবনাদি নির্মাণ, ল্যাব যন্ত্রপাতি কেনা, পরামর্শক সেবা, অভ্যন্তরীন প্রশিক্ষণ, গাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য।

ব্যয়ের হিসাব থেকে জানা গেছে, এই ভবন নির্মাণের জন্য পরামর্শক সেবা খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। যেখানে মোট পরামর্শক হলো ৪১৩ জনমাস। অর্থাৎ প্রতি মাসে জনপ্রতি পরামর্শক খাতে খরচ হবে ৩৬ লাখ টাকার বেশি। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ভবন নির্মাণে ৭১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও ভ্যাট প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণে ৪১৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের আবাসিক ভবনাদি নির্মাণে ১৩২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও ভ্যাট প্রশিক্ষণ একাডেমির আবাসিক ভবনাদি নির্মাণে ৬০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ১ হাজার ৬০২টি ল্যাব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় ১২৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে ৭ হাজার ৬৫০ জনের পেছনে ব্যয় ১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর চারটি গাড়ি ভাড়ায় ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ খরচ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ টাকা। আপ্যায়নে ৪০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এ বন্দরের মাধ্যমে হয়। এ বন্দরে প্রতিদিন ১৩ হাজার ডিক্লারেশন সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৯ সালে এ বন্দরে ৪৫ হাজার ৭০০ জন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিদিন এখানে সাত হাজার মানুষ সেবা গ্রহণের জন্য আসেন। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা ক্রমবর্ধমান সেবা গ্রহণের চাহিদার সাথে তাল মিলাতে সক্ষম হচ্ছে না। নিকটবর্তী কলকাতা বলয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়টি বিবেচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ফলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে সব সমস্যার সম্মুখীন তা থেকে উত্তরণের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজসহ সব কাস্টমস হাউজের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বন্দরগুলোর আধুনিকায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ বলছে, পিইসি সভায় পরামর্শক খাতের ব্যয় ও সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য বলা হয়েছিল। অন্যান্য খাতের ব্যয়কেও যৌক্তিক করার জন্য বলা হয়। তবে প্রকল্পটি জরুরি বিধায় অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/734080