১৪ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:০০

লিংগ সমতা, উন্নয়নে নারী ও মহিলাদের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গ

-ড. মো. নূরুল আমিন

গত ৮ মার্চ সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। জাতিসংঘ এ বছর Commission on the Status of women-এর আসন্ন ৬৭তম অধিবেশনের অগ্রাধিকার প্রতিপাদ্যের সাথে সংগতি রেখে বর্ণিত নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে “Digitall : Innovation and technology for gender equality” অর্থাৎ ডিজিট-অল : লিংগ সমতার জন্য নতুন ধারা ও প্রযুক্তি। এই দিবসে নারী পুরুষ সমতা এবং নারীদের ক্ষমতায়ণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার উপর সর্বত্র জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া উপরোক্ত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে উন্নয়নে নারীদের প্রাধান্য প্রদান, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে ছেলেদের সাথে মেয়েদের সমতা বিধান এবং এমন কি বাল্য বিবাহ রোধ ও পর্দা সিস্টেম থেকে মেয়েদের মুক্ত করার দাবি জানিয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ ও সভা সমাবেশ ও টকশো’র আয়োজন করা হয়েছিল। এসব অনুষ্ঠানে আলোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত নারী উন্নয়ন নীতি এবং উত্তরাধিকার আইনে কন্যার তুলনায় পুত্রের দ্বিগুণ সম্পত্তি পাওয়া এবং শুধু কন্যা সন্তান রেখে কেউ মারা গেলে কন্যারা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং তাদের পরিবর্তে চাচাত, জেঠাত ও মামাতো ভাইসহ অন্যরা সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাওয়া সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর কথিত উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে অবিলম্বে মেয়েদের অধিকার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন। উন্নয়নে মহিলাদের নিয়ে আমাদের দেশে গত কয়েক দশক ধরেই ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলে আসছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ^ব্যাপী নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কোপেন হেগেন সম্মেলন এবং বেইজিং সম্মেলনের কার্যকলাপের সাথে পেশাগত কারণে আমার সম্পৃক্ত হবার সুযোগ হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করার আমার সুযোগ হয়েছিল।

আমার দৃষ্টিতে জেন্ডার ডেভেলাপমেন্ট ও উন্নয়নে মহিলা বিষয় দু’টি সংবেদনশীল ও আবেগঘন। এখানে তাত্ত্বিক আলোচনায় Value judgement-এর বিষয় এসে যায়। ভাবাবেগ ও মূল্য বিচারের ভিত্তিতে কয়েকটি প্রশ্নও এখানে প্রাসঙ্গিক।

বলাবাহুল্য উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন নয়। আমাদের দেশ ও সমাজে অনেক মহিয়সী নারী ছিলেন। পাশ্চাত্যের নারীদের কাছ থেকে আমাদের মা ও বোনেরা অনেক অগ্রগামী ছিলেন। আমরা এখন যা বলছি তা কি আমরা ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে বলছি? কোনও ইস্যুর যদি সুচারু সমাধান প্রয়োজন হয় তাহলে বিষয়টি অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ থেকে উচ্চারিত হতে হবে। বাইরে থেকে হলে internalize করা আবশ্যক। আমরা কি তা করছি ? নারী অধিকার, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এগুলোর শতকরা ১০০ ভাগই আমদানিকৃত; এগুলো আত্মস্থ করার মতো অবস্থায় আছে কিনা তাও আমরা তলিয়ে দেখিনি। যেসব পাশ্চাত্য দেশ থেকে এগুলো আমরা আমদানি করছি সেসব দেশে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে পড়েছে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই জারজ সন্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-কর্মকর্তারা জেনা ব্যভিচার ও নারী কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। নারীর শ্লীলতা ও সতিত্ব এসব দেশে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বউ পিটানো পরকীয়া এসব দেশের কালচারে পরিণত হয়েছে। যে কোন নতুন সামাজিক প্রকল্পের (সেটা নারী উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়ন অথবা উত্তরাধিকারের নতুন Concept যাই হোক না কেন) ক্ষেত্রে Social Compatibilty প্রারম্ভিক বিষয়। যে সমাজের জন্য করছি তা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সহনশীল করতে পারবো তা দেখা অপরিহাযঅ। প্রত্যেক সমাজের একটা নিজস্ব মূল্যবোধ আছে। আপনি আপনার নিজস্ব Value Judgement এ তাদের অসভ্য বলে অভিহিত করে সভ্য বানাতে যাবেন না। তাদের মূল্যবোধকে আহত করবেন না। মানবতা স্বীকৃত পন্থা এটি নয়। বিয়ার, হুইস্কি, চেম্পেইন, কোকাকোলা, ভোডকা প্রভৃতি পাশ্চাত্য সভ্যতার অংশ। তাকে আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা একটি ধৃষ্টতা, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। নদী নিয়ে খেলা নিরাপদ নয়। আপনি জানেন না একদিকে বাঁধ দিয়ে এক হাজার একর উদ্ধার করলে অন্য স্থানে সে পাঁচ হাজার একর নিয়ে যেতে পারে। নদী থেকে শত সহ¯্র গুণ জটিল সমাজ এবং সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজ নিয়ে খেলার বিপদ অনেক বেশী।

পাঠকদের মনে থাকতে পারে যে, গত দশকের শুরুতে সরকার কতৃর্ক গৃহীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে দেশব্যাপী বিভ্রান্তি এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই উৎকণ্ঠা যত না নারী সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ইসলামী আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও সর্বক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা নিয়ে। বস্তুত মুসলিম সমাজে উত্তরাধিকার আইনটি এতই স্পর্শকাতর একটি বিষয় যে, এর সামান্য হেরফের বা পরিবর্তন যে কোনো সময়ে সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এর কারণ নারীদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করায় পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা বজায় রাখা নয় বরং পবিত্র কুরআনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সুস্পষ্ট ও সরাসরি যে নির্দেশ ও নির্দেশনা রয়েছে তার লংঘন। আল কুরআন আল্লাহর কালাম, মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাধ্যমে তা নাজিল হয়েছে। এটি মুসলমানদের জন্য একটি সংবিধান, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি দিক-নির্দেশনা। এই কুরআন যারা বিশ্বাস করেন না, তার নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করেন অথবা পরিবর্তন করেন তারা মুসলমান হবার প্রাথমিক যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেন। কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার আইন সরকারিভাবে যদি পরিবর্তন করা হয় তাহলে কুরআন পরিপন্থী এই পরিবর্তিত আইনটি দেশের প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্য প্রযোজ্য হয়ে যাবে এবং তাদের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কুরআনের নির্দেশনা লংঘন ও তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনে তারা বাধ্য হবেন। ঈমানদার কোনও মুসলমান এই কাজটি করার জন্য প্রস্তুত নন এবং সরকারিভাবে যারা তা চাপিয়ে দিতে চান তাদের প্রতিহত করার জন্য আন্দোলনে নেমে যান। এই আন্দোলনকে তারা ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেন। এই অবস্থার আলোকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল দেশেই মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের পরিবর্তনকে সর্বদা অবাঞ্ছিত গণ্য করা হয়েছে। এই উপমহাদেশে অমুসলিম বৃটিশ শাসকরা প্রায় পৌনে দু’শ বছর শাসন করেছে কিন্তু তারা উত্তরাধিকার আইন সংশোধন বা পরিবর্তন করেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় ১৯৬০ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারী করে এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন, আলেম সমাজসহ দেশের ঈমানদার মুসলমানরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এই পরিবর্তন কোনও কল্যাণ আনতে পারেনি। আইন ও অধিকারের ভারসাম্য নষ্ট করায় একজনকে দিতে গিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করেছে মাত্র। তার অর্ধশতাব্দি পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নারী উন্নয়ন নীতির নামে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের ধুয়া তুলে কুরআন নির্দেশিত উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তনে ব্রতী হবার অভিযোগ উঠেছিল। এই নীতিমালায় নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছে। নারীনীতির ২৫.২ অনুচ্ছেদে বিধৃত এই অঙ্গীকারটি নিয়েই দেশব্যাপী উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছিল। কেবিনেট সভায় অনুমোদিত উন্নয়ন নীতির যে কার্যপত্রটি বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া গেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও কার্যত কুরআনের উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্ত্রিসভায় আলোচিত ও অনুমোদিত নারীনীতিতে জাতিসংঘ ঘোষিত নারীর প্রতি সর্বপ্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। এই সনদে নারী-পুরুষের সমানাধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে।

বলাবাহল্য, সিডো সনদের অধিকাংশ ধারা কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় সবগুলো মুসলিম দেশ এই সনদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই সনদ বাস্তবায়নে হঠাৎ করে উদগ্রীব হয়ে পড়ার কারণ বোধগম্য নয়। নারী নীতিমালার ২৫.২ অনুচ্ছেদের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এই অনুচ্ছেদ ছাড়াও এর ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.২. ১৭.৪, ১৭.৬, ২৩.২ ও ২৩.৫ অনুচ্ছেদসমূহে বিধৃত নীতিমালা বিতর্কিত এবং এগুলো কার্যকর করতে হলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পক্ষান্তরে সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি সভায় আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নারীনীতি ভালো করে না বুঝে, না পড়ে অমূলকভাবে সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি করছে। মৌলবাদী গোষ্ঠী, নারীনীতির যে বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সেই ‘উত্তরাধিকার’ বিষয়ে নারীনীতিতে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি। আইনমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যে তারাই সব বুঝেন, তারাই সব পড়েন, তারাই সব জানেন। অন্যরা গন্ডমূর্খ, কিছুই জানেন না, বুঝেন না। সিডো ঘোষণা যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অবহিত রয়েছেন যে, এই ঘোষণায় নারীর উত্তরাধিকারের বিষয়টি অন্তত ১৭ বার এসেছে এবং সরকার এই ঘোষণাটি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকার এই রাখ-ঢাকের আশ্রয় নিচ্ছেন কেন? কেন তারা স্বীকার করতে চাচ্ছেন না যে, এই নীতিমালায় তারা উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে তাতেও সমতা আনতে চাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথিত মন্তব্যটি এ ব্যাপারে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ কখনোই কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। ধর্মপ্রাণ মানুষকে সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় কোথাও ইসলামের পরিপন্থী কোনও কথা নেই। একটি গোষ্ঠী নীতিমালাটি ভালোভাবে না পড়ে বা না জেনে অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের প্রতি নারী উন্নয়ন নীতিমালা পড়ার আহ্বান জানিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি। মৃত্যুর পর পিতা-মাতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওপর মেয়েদের অধিকারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যাদের পুত্র সন্তান নেই তাদের মেয়েরা রেখে যাওয়া সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে না। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা সেই সম্পত্তি দখল করে নেয়। পিতামাতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি যাতে মেয়েরা পেতে পারেন সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার জন্যও প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মনে করেন আপনি একজন পিতা। আপনার কোনো পুত্র সন্তান নেই। অথচ মৃত্যুর পর আপনার সম্পত্তি অন্যরা দখল করে নিচ্ছে। আপনার স্ত্রী মেয়ে পাচ্ছে না। তখন আপনার কেমন লাগবে? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রদত্ত ইঙ্গিতটি প্রচ্ছন্ন হলেও সুস্পষ্ট। এর দু’টি অংশ। একটি হচ্ছে তার দল কর্তৃক অতীতে, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন না করা প্রসঙ্গে। তার এই কথাটি এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কতটুকু গ্রহণ করবেন তা আমি জানি না। তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ইসলামকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে সংবিধানে বিবৃত অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের স্থলে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতিস্থাপন এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি হিসেবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের অনুচ্ছেদটির অবলোপন (অনুচ্ছেদ ৮(১) ও ৮ (১ক)), মুসলিম মেয়েদের পর্দার উপর বিধি নিষেধ আরোপ, ফতোয়া বিতর্ক, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করার অপপ্রয়াস এবং সরকারীভাবে পাইকারী হারে আলেম উলেমাদের মৌলবাদী ও জঙ্গী অপবাদ প্রদান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যিনা ব্যভিচারের প্রসার ও নারী নির্যাতন, বিদআতি কার্যকলাপকে উৎসাহ প্রদান, বরেণ্য আলেমদের নির্যাতন, তাফসীর মাহফিলের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী না তার অনুকূল- দেশবাসী তা নিশ্চয়ই বিচার করে দেখবেন। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে অনেক গুরুত্ব বহন করে। তার বক্তব্যে সত্যের প্রতিফলন ঘটবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করেন। প্রথমত: তিনি অভিযোগ করেছেন যে, নারীনীতি না পড়ে না বুঝে অনেকেই তার বিরোধিতা করছেন। এতে উত্তরাধিকারের কোন বিষয় নেই। এরপরই তিনি তার বক্তৃতায় বলেছেন যে, যাদের পুত্র সন্তান নেই তাদের মেয়েরা রেখে যাওয়া সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে না। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা সেই সম্পত্তি দখল করে নেয়। এই সম্পত্তি মেয়েরা যাতে পেতে পারে সে ব্যাপারে তিনি পরামর্শ কামনা করেছেন। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে, এক : নারীনীতিতে যদি উত্তরাধিকারের বিষয়টি না থেকে থাকে তা হলে তিনি এই বিষয়টি তুলে আনলেন কেন? এটা কি ঠাকুর ঘরে কলা খাওয়ার মত বিষয় হয়ে গেল না? দ্বিতীয়ত : পুত্রহীন একজন মুসলিম পিতার মৃত্যুর পর তার কন্যারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাবেন না এই তথ্যটি তিনি কোথায় পেলেন? কথাটি হিন্দু আইনের বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে কিন্তু ইসলামের উত্তরাধিকার আইন তো এ কথা বলে না! প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যটি কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সূরা নিসার ১১ নং আয়াতে এ ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে ‘‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের (অংশ পাবার) ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। আর যদি কন্যাগণ দুই এর অধিক হয় (পুত্র না থাকে) তা হলে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তির ২/৩ অংশ (দুই তৃতীয়াংশ) পাবে, আর একটি মাত্র কন্যা থাকলে পাবে অর্ধেক অংশ। মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে পিতামাতা অর্থাৎ উভয়ের প্রত্যেকের জন্য ছয়ভাগের একভাগ, যদি সন্তান না থাকে এবং পিতামাতাই উত্তরাধিকারী হয় তাহলে মাতার প্রাপ্য এক তৃতীয়াংশ। আর যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক ভাইবোন থাকে তা হলে মাতা পাবে ছয়ভাগের একভাগ। এইসব অংশ বের করতে হবে মৃত ব্যক্তির অছিয়ত আদায় করার পর এবং ঋণ পরিশোধ করার পর। তোমাদের পিতা এবং সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী তা তোমরা অবগত নও। এটি আল্লাহর বিধান। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’’

এই আয়াতে পুত্রহীন পিতার মৃত্যুর পর কন্যা বা কন্যাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে এবং বিগত দেড় হাজার বছর ধরে মুসলিম বিশ্বে এবং মুসলিম সমাজে তা অনুসৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কোথায় পেলেন যে পুত্রহীন অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার কন্যা বা কন্যারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার পান না আমার কাছে তা বোধগম্য নয়। একটি মুসলিম দেশের মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে নারীর অধিকার ও ফারায়েজ সম্পর্কে কিছু জানেন না অথবা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন এই কথাটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি নারীনীতি পড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করেছেন। আমি বলবো আমরা নারীনীতি অধ্যয়ন করেছি। তিনি যদি মেহেরবানী করে কুরআন সুন্নাহ প্রদত্ত নারীর অধিকার ও ফারায়েজ অধ্যয়ন করেন এবং তা অনুশীলনে জাতিকে সাহায্য করেন তাহলে দেশবাসী কৃতার্থ হবেন। একটি বিষয় অনেকেই জানেন না যে ইসলামী আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন হতে পারে না। এজন্য কতিপয় হক আদায় করতে হয়।

এগুলো হচ্ছে ঃ (১) মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে সর্বপ্রথম তার দাফন কাফনের ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। (২) এরপর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে তার ঋণ (যদি থাকে) পরিশোধ করতে হবে। আবার তার স্ত্রীর দেনমোহর আংশিক বা সম্পূর্ণ যদি অপরিশোধিত থাকে তাহলে তাও পরিশোধ করতে হবে। ঋণ বা দেনমোহরের পরিমাণ যদি পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমান বা বেশি হয় তা হলে কেউই সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাবেন না। দেনমোহর ও ঋণ পরিশোধেই তা ব্যয়িত হবে। (৩) ঋণ ও স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধের পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকবে তার এক তৃতীয়াংশ ব্যয়িত হবে অছিয়ত বাবদ (যদি থাকে)। বলাবাহুল্য, জনকল্যাণের জন্য ইসলামে অছিয়ত করা যায়। কোনো উত্তরাধিকারীর অনুকূলে অছিয়ত জায়েজ নয়। আবার এক তৃতীয়াংশের বেশি অছিয়তও করা যাবে না। উপরোক্ত তিনটি হক আদায়ের পর যদি সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে তাহলে উত্তরাধিকারীদের প্রকারভেদ অনুযায়ী বণ্টন হবে। উল্লেখ্য যে, ইসলামী আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীগণকে মোট তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন ১. যাবিল ফুরুজ। পবিত্র কুরআনে যে সকল উত্তরাধিকারীগণের অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে অথবা সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা যাদের অংশ প্রমাণিত রয়েছে তারাই হচ্ছেন যাবিল ফুরুজ বা অংশীদার। যাবিল ফুরুজদের জন্য পবিত্র কুরআনে মোট ৬টি অংশ নির্দিষ্ট আছে। এই ৬ প্রকারের অংশের জন্য পবিত্র কুরআনে মোট ১২ জনকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪জন পুরুষ এবং ৮ জনই নারী। এক্ষেত্রে ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কন্যাসন্তান হিসেবে তাকে অবহেলা করা হয়নি। এতে আল্লাহপাক কন্যার অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন পুত্রের অংশ নয়, নি:সন্দেহে এটা কন্যাদের জন্য সম্মানজনক ব্যাপার। মৃত ব্যক্তির অন্য কোন ওয়ারিশ থাকুক বা না থাকুক কন্যার নির্দিষ্ট অংশ সে পাবেই। অন্যদিকে সবাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যাবার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা পাবে পুত্র। অবশ্য মৃত ব্যক্তির যদি পুত্র ও কন্যা থাকে তাহলে বলা হয়েছে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ, অর্থাৎ পুত্র কন্যার দ্বিগুণ পাবে। এর প্রধান কারণ পুত্র সন্তানের উপর অর্পিত পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব, ভাই বোনের ভরণপোষণ, শিক্ষা দীক্ষার ব্যয়ভার বহন ও আত্মীয় স্বজনের দেখভাল পরিচর্যা ইত্যাদি। মেয়েদের এক্ষেত্রে কোন দায় নেই, তারা দেন মোহর পায়। স্বামী তাদের ভরপোষণ করে, স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তির অংশীদার হয়। বৈধ পেশায় উপার্জিত তাদের অর্থ সংসারে খরচ করার জন্য তারা বাধ্যও নন। কেন তারা বেশি পান এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ আমার আজকের আলোচনার বিষয় নয়। সরকার তার নারী নীতিতে নারীনেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে মেয়েদের যে বঞ্চনার উল্লেখ করেছেন আমি এ ব্যাপারে আজ সামান্য তথ্যই তুলে ধরলাম। আমি ইসলামী আইনে উত্তরাধিকারীদের প্রকারভেদ নিয়ে কথা বলছিলাম। যাবিল ফুরুজের পর মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি যারা পান অথবা তাদের অবর্তমানে যারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন তাদেরকে আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী বলা হয়। এরা দু’প্রকার, মৃত ব্যক্তির সাথে বংশগত দিক থেকে সম্পর্কিত (আসাবায়ে নসবিয়া)। এরপর রয়েছে আসাবায়ে সববিয়া (বিশেষ কারণে সম্পর্কিত)। এর কোন ক্ষেত্রেই নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি। যদি হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মে বিধৃত আইন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম কন্যা সন্তানদের উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়নি। হিন্দু আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বেলায় দুটি পদ্ধতি চালু আছে। এর একটি দায়ভাগ পদ্ধতি, অন্যটি মিতাক্ষরা পদ্ধতি। দায়ভাগ পদ্ধতিতে তিন শ্রেণীর লোক মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি পেতে পারেন। এরা হচ্ছেন সপিন্ড, সাকুল্য ও সমানোদক। যারা শ্রাদ্ধে পিন্ড দান করে তারাই সপিন্ড। বলা নিষ্প্রয়োজন যে কোন কন্যা সন্তান পিন্ডদান করতে পারে না। তাদের সপিন্ডের সংখ্যা ৫৩ জন। আবার সপিন্ডের কেউ জীবিত থাকলে সাকুল্য বা সমানোদক কেউ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। নারীরা এখানে বঞ্চিত। এ প্রেক্ষিতে প্রয়াত বাবু সুরঞ্জিত সেন যথাযথই বলেছিলেন যে, মুসলিম নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় হিন্দু নারীরা হয় না। তাদের উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। নারীরা সমানাধিকার পাক তাতে কারুর আপত্তি থাকতে পারে না। তবে তাদের কাছ থেকে মাতৃত্বকে কেড়ে যদি পুরুষ বানানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে সমাজে যে ধস নামবে তা ঠেকানো যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ভাল জাতি গঠনের জন্য শিক্ষিতা, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও চরিত্রবান মায়ের প্রয়োজন। মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি, তাদের শারীরিক গঠনশৈলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে পারিবারিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিকশিত হবার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার এবং তারা যাতে শোষণ নির্যাতনের শিকার না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান সরকারের দায়িত্ব। নারীদের এখন ভোগের সামগ্রী ও বিজ্ঞাপনের পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। এর অবসান হওয়া দরকার। সংস্কৃতির নামে তাদের উলঙ্গপনার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই সরকার নারীদের যে অপমান করেছেন তারও অবসান হওয়া দরকার। মোদ্দাকথা নারী নীতিতে বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করে জাতির আশা আকাঙ্খা, ইতিহাস ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটুক এটাই আমরা কামনা করি।

 

https://dailysangram.com/post/519139