১৩ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ১২:২৪

বাজারে বিষণ্ন মুখ

মাংস-মাছ পাতে তোলা কঠিন

রাশেদ খান। ঢাকার সীমান্ত স্কয়ারে একটি বিপণি বিতানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন। বেতন পান ১৫ হাজার টাকা। সদ্য বিয়ে করেছেন। স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছেন। হঠাৎ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন। বেতনের সঙ্গে খরচ মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রতি মাসের ১২ তারিখের মধ্যে বেতন দেয়। মাসের শুরুতে ৪ দিন ঘরে খাবার সংকট ছিল। শুধু ভাত রান্না করে আলু ভর্তা দিয়ে খেতে হয়েছে।

স্ত্রীকে ঢাকায় এনে বিপদে পড়েছি। যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। জিনিসপত্রের দাম না বাড়লে, এত সমস্যা হতো না। আগে এই টাকা দিয়েই মাস চলে যেত। এখন ১৫-২০ দিনই চলে না। বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবো? ভেবে পাচ্ছি না। রাজধানীর রায়েরবাজার সিটি করপোরেশন মার্কেটে বাজার করতে এসে এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন রাশেদ। তিনি আরও বলেন, অভাব অনেক, বলার জায়গা নেই। ওষুধ থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য সবকিছুর দাম বেড়েছে। কমার সম্ভাবনা নেই। এভাবে চললে স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে ব্যাচেলর থাকতে হবে। এ ছাড়া উপায় দেখছি না। সবকিছুর দাম বেড়েছে। বেতন কিন্তু বাড়েনি। বাজারের সবচেয়ে কম দামি পাঙ্গাশ আর তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। আলু ভর্তা ও ডাল ভাত খেতেই সব টাকা শেষ হচ্ছে। মাছ-মাংস কিনবো কীভাবে। আগে সমস্যা হলে আত্মীয়দের সহযোগিতা পাওয়া যেত। এখন কেউ কাউকে সহযোগিতা করতে পারছে না।

একই বাজারে কথা হয় রমিজ উদ্দিনের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব রমিজ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, সপ্তাহে দুইবার বাজার করি। শনিবার বাজার করে যাওয়ার পর বুধবার এসে দেখি জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু বাজারের বাজেট বাড়াতে পারছি না। হিসাব করে টাকা নিয়ে বাজারে আসি। পরে দেখা যায় অর্ধেক বাজারই করতে পারি না। তাই তালিকা কাটছাঁট করেই বাজার করে ফিরতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাঁচা দায় হয়ে যাবে। মাসে একবার গরুর মাংস খেতাম। দাম বাড়ায় আর খাওয়া হচ্ছে না। এখন ব্রয়লার মুরগি খাওয়াও দুষ্কর হয়ে যাবে। এই সপ্তাহে মুরগিও কিনতে পারিনি।

বাজার করতে আসা পারুল বেগম নামে এক নারী বলেন, সকালে মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে বাজার করতে এসেছি। কিন্তু কাঁচাবাজারে দেখছি প্রতি সবজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। কী কিনবো বুঝতে পারছি না। টাকায় না হলে অল্প কিছু সবজি নিয়েই ফিরতে হবে। পেট আছে তো, খেতে হবে, যত দিন বেঁচে আছি। এভাবেই চলতে হবে, কিছু করার নাই। মাংসের দাম বাড়ার পর দোকানে আর ফিরেও তাকাই না। বাজারে কাটা মুরগি খুঁজলাম কিন্তু পাইলাম না। ভাবছি সন্ধ্যায় এসে কিছু গিলা কলিজা কিনমু। গরিবের মাংসের স্বাদ নেয়া দায় হয়ে গেছে।

খলিল আহম্মেদ নামের একজন ব্যাংকার বলেন, সব কিছুর দাম শুধু বাড়ে। কমেছে কখনো শুনিনি। সবজির দাম বাড়ছে, মাছের দাম বাড়ছে, ডিমের দাম বাড়ছে। তাহলে মানুষ খাবে কী? রমজানে আরও বাড়বে। জানি না- এর সমাধান কবে হবে। সরকার তেলের দাম কমিয়েছে কিন্তু দোকানে তা কমেনি। যে পণ্যের দাম বাড়ছে, সেটা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। সম্ভব হলে সাময়িকভাবে বাদ দিবো। যেমন মুরগি খাওয়া বাদ দিয়েছি, যতদিন দাম কমবে না, ততদিন মুরগি খাবো না। এ ছাড়া উপায় নেই। বাজারের সঙ্গে পেরে উঠছি না।

মাত্র কয়েকদিন পরেই মাহে রমজান। রোজাকে সামনে রেখেই দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। আজ এক পণ্যের দাম বাড়লে, কাল বাড়ছে আরেক পণ্যের দাম। মূল্যবৃদ্ধি যেন থামছেই না। এতে চরম বিপাকে পড়েছে নি¤œ আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তরাও খরচ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। দাম বাড়ায় বাজার তালিকা নিয়মিত কাটছাঁট করছেন। যেন হাঁসফাঁস অবস্থা। গরুর মাংস আগেই নাগালের বাইরে চলে গেছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ব্রয়লার মুরগির দামও। মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা। ফলে অস্বস্তিতে রয়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। অনেকে মাংস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, এখনই নিত্যপণ্যের এত দাম, রমজান মাসে কী অবস্থা হবে?

বাজার ঘুরে দেখা গেছে- চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, লবণসহ বাজারের অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে দোকানিরা বলছেন, রমজানে দাম আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েও গেছে। তবে আমরা এখনো আগের কেনা দামেই বিক্রি করছি। নতুন মাল আনলে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হবে। কিছু করার নেই।

ব্রয়লারের সঙ্গে সোনালি মুরগির দামও আরেক দফা বেড়েছে। খাসির মাংসেও লেগেছে দামের বাড়তি আঁচ। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৬০ থেকে ৮০০ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও গরুর মাংস বিক্রি হতো ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০ থেকে ১১শ’ টাকা দরে। আগে বিক্রি হতো এক হাজার টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা দরে। গত সপ্তাহে ছিল ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা দরে। দুই সপ্তাহ আগে সোনালি মুরগির কেজি ছিল ৩১০-৩২০ টাকা। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা। গত সপ্তাহে লেয়ার মুরগির কেজি ছিল ৩১০-৩২০ টাকা।

ধানমণ্ডির ঝিগাতলা বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা মো. রাজু আলম বলেন, খামারির খরচ বেড়েছে। গরু পরিবহন খরচও বেড়েছে। তাই বাড়তি দামে গরু কিনে সেই দাম মেলাতেই বাড়াতে হচ্ছে। মুরগির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, পোল্ট্রি খাদ্য, বাচ্চা, ওষুধের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। এসব কারণে খামারিরা বর্তমানে শেডে মুরগির বাচ্চা তুলছেন না। তারা অভিযোগ করেন, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মুরগির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পরেই পাইকারি বিক্রেতারা ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়িয়েছেন কেজিপ্রতি ২০ টাকা।
নিত্যপণ্যের বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিকন চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা, মোটা চাল কেজি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ১৪০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ১১০ টাকা, ছোলা প্রতি কেজি ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি আটার প্যাকেট ৭০ টাকা, ময়দার কেজি ৮০ টাকা, সয়াবিন তেল বোতল ১৮৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবজি এক এক জায়গায় এক এক দামে বিক্রি হচ্ছে। ধানমণ্ডির ঝিগাতলা কাঁচাবাজারে পটল প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা ও শসা ৪০ টাকা। বেগুন প্রতি কেজি ৬০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ১২০ টাকা, করলা প্রতি কেজি ৮০ টাকা, সজনে প্রতি কেজি ২০০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৮০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা, আকারভেদে ফুলকপি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, শিম প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

https://mzamin.com/news.php?news=46473