১৩ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ১২:১৫

দ্বিতীয় দিনেও উত্তাল রাবি

প্রশাসন ভবনে শিক্ষার্থীদের তালা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে গতকাল দ্বিতীয় দিনেও ক্যাম্পাস ছিল উত্তাল। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল দিনভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ছাত্ররা। এ সময় তারা প্রশাসন ভবনে তালা লাগিয়ে হামলার বিচার দাবি করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে ভিসিকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করেন তারা। পরে রাবি প্রশাসনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা।

গত শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ ও ছররা গুলি বর্ষণ করে। এ ঘটনায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। এ দিন সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার প্রতিবাদে প্রশাসন ভবন ঘেরাও করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। পরে প্রশাসন ভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগ দাবি করেন।

গতকাল শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, সংঘর্ষের ঘটনায় রাত ১২টা পর্যন্ত আমরা প্রক্টরকে দেখতে পাইনি। একজন প্রক্টরকে অনেক সাহসী হওয়া উচিত। মেরুদণ্ডহীন কোনো লোক এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসা উচিত নয়। আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, আর প্রক্টরের কোনো খোঁজ নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, ‘প্রক্টরের কাজ কী? এমন দায়িত্বহীন প্রক্টরের অবিলম্বে পদত্যাগ চাই। পরে তারা প্রশাসন ভবন থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ভিসির বাসভবনে গিয়ে শেষ হয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে কয়েকটি দাবি জানিয়ে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন।

শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ আবাসিক হিসেবে গড়ে তোলা, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা, ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; অন্যথায় এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে গ্রহণ করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণীতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করা।

এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদক্ষেপের গাফিলতি ও পুলিশ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির অভিযোগ তুলে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয়ার পর ভিসি অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টায় ভিসি শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচির দাবি শুনতে আসেন। এ সময় ভিসি সম্মুখ আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু বিক্ষিপ্ত শিক্ষার্থীরা বিনোদনপুর সংঘর্ষের ঘটনাস্থলে গিয়ে সবার সাথে আলোচনায় আসতে বলেন। এতে ভিসি সম্মত না হলে তাকে ভেতরে রেখে শিক্ষার্থীরা চার দিক থেকে আটকে ধরেন। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে তাকে দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

টানা দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ছাত্রলীগের সহায়তায় মুক্ত হন রাবি ভিসি। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে ভিসিকে তার বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

প্রক্টরের প্রতীকী জানাজা : সংঘর্ষের ঘটনায় প্রক্টরের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকে নীরব ভূমিকা পালন করার অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তার প্রতীকী নামাজে জানাজা পড়েন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে কফিন বক্সকে প্রক্টরের প্রতীকী সাজিয়ে নামাজে জানাজা পড়েন তারা। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগ টেনে মুনাজাতও করেন তারা। পরে বাক্সটি পুড়িয়ে দেয়া হয়।
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব ও আট প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিনোদপুর বাজারের দোকানপাট অধিকাংশ বন্ধ ছিল এবং ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক বাস চলাচলে অস্বাভাবিকতা ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : গতকাল রোববার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞাপ্তির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার অবস্থান নিশ্চিত করেন। এতে বলা হয়, শনিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের বিনোদপুর গেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের সাথে কিছুসংখ্যক এলাকাবাসীর যে অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয় তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মর্মাহত। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভিসির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যায় বিনোদপুর গেট সংলগ্ন এলাকায় এলাকাবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় এবং এতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। ঘটনার একপর্যায়ে পুলিশের রাবার বুলেট নিক্ষেপের ফলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এলাকাবাসী ও পুলিশ সদস্যের এসব কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ চিকিৎসার সব ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে স্থানীয় মতিহার থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী বিনোদপুর ও আশপাশের মেসে অবস্থান করছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৎপর আছে এবং মেস মালিক ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে। এ দিকে গত সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে জড়ো হতে থাকেন এবং অগ্নিসংযোগ করেন।
৫০০ জনকে আসামি করে মামলা, গ্রেফতার ১

শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেলে রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম বাদি হয়ে নগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলার পর তসলিম আলী ওরফে পিটার (৪৫) নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারের বাসের চেইন মাস্টার। নগরীর খোজাপুর এলাকায় তার বাসা।

মতিহার থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, সংঘর্ষের জন্য বাসের চেইন মাস্টার তসলিমের বড় ভূমিকা আছে। মামলা হওয়ার পরে বিনোদপুর থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে। এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় বাসের ভেতর এক রাবি শিক্ষার্থীর সাথে কথাকাটাকাটির জের ধরে সহপাঠীরা বিনোদপুর বাজারে চালক ও হেলপারকে মারধর করেন। বাস থেকে পেটাতে পেটাতে চালককে নামিয়ে মারধর করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এতে বাধা দিলে তাদের সাথে শিক্ষার্থীদের বিরোধ লেগে যায়। এরপর রাতভর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রেললাইনে রাবি শিক্ষার্থীদের আগুন, ট্রেন চলাচল বন্ধ : এবার রেললাইনে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এতে রাজশাহী-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে।

গতকাল রোববার রাত পৌনে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী রেললাইনে আগুন দেন তারা। পশ্চিম রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসিম কুমার তালুকদার গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, রাবি শিক্ষার্থীদের দেয়া আগুনের কারণে রাজশাহীর সাথে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি পেলে ট্রেন যোগাযোগ আবারো চালু করা হবে।

অসিম কুমার আরো বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি ট্রেন আটকা পড়েছে। অনেক ট্রেন ছেড়ে যেতে পারছে না। যাত্রীরা চাইলে ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিতে পারবেন। এর আগে স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে কয়েক দফা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/733864