১২ মার্চ ২০২৩, রবিবার, ১২:৪৫

কভিডের প্রভাবে দুর্ভোগ বেড়েছে

দুই সপ্তাহ ধরে কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বেড়েছে বরুণ সরকারের। ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছেন। কাজ হচ্ছে না। তাই রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে।

শয্যা খালি না থাকায় হাসপাতালের বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাসিন্দা বরুণ সরকার। শুধু বরুণই নন, গতকাল শনিবার ওই হাসপাতালে এমন আরো অনেক রোগী দেখা যায়, যারা শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যাজমার চিকিৎসা নিতে এসেছে।

বরুণ সরকার বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট-কাশি প্রতিবছরই হয়। ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবার কিছুতেই কাশি কমছে না। চিকিৎসক দেখে গত মঙ্গলবার ভর্তি দিয়েছেন। কিন্তু এখনো বিছানা পাইনি। তাই দিনে হাসপাতালের বারান্দায় থাকি, চিকিৎসা নিই। রাতে হাসপাতালের পাশেই ভাড়া থাকি। প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে দিতে হয়।’

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (আরপি) সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, কভিডে অনেকের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। দেখা গেছে, যেসব রোগীর আগে থেকে অ্যাজমা ছিল, তাঁরা ওষুধ খেলে ভালো থাকতেন। কিন্তু কভিড হওয়ার পর থেকে ওষুধে খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। কিছুদিন পর পরই সমস্যা হচ্ছে। যাঁরা কভিডে আক্রান্ত ছিলেন, তাঁদের ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে ধুলাবালিতে এখন সমস্যাটা বেশি হচ্ছে।

বহির্বিভাগের রোগী বেড়ে তিন গুণ : গতকাল জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, রোগীদের বসার জায়গা ভরে গিয়ে লাইন চলে গেছে বারান্দা পর্যন্ত। ক্লান্ত হয়ে অনেকে বসে পড়েছে মেঝেতে। কেউ আবার বারান্দায় বরুণের মতো বিছানা পেতে শুয়ে আছে।

ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য বছর এই সময়ে বহির্বিভাগে গড়ে ২০০ রোগী দেখতে হতো। এখন দেখতে হচ্ছে প্রায় ৬০০ জন। আগে ১০০ রোগী দেখলে ভর্তির প্রয়োজন হতো ১০ জনের। এখন ভর্তির প্রয়োজন হচ্ছে ৩০ জনের। তখন বহির্বিভাগে রোগী দেখতেন পাঁচজন চিকিৎসক, এখনো পাঁচজনেই দেখেন। তখনো বিছানা ৬৭০টি ছিল, এখনো তাই রয়েছে। মূলত এ কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছিল ১১ হাজার ৩৩ জন।

ফেব্রুয়ারিতে ১০ হাজার ৮৫০ জন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চিকিৎসা নেয় ১৩ হাজার ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৪ হাজার ৩৮১ জন। এই সংখ্যা মার্চে আরো বেশি বলে জানান এ চিকিৎসক।

ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে রোগী বাড়ার আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেমন—কভিড-পরবর্তী সময়ে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। এ ছাড়া জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তারা এখন আর আগের মতো প্রাইভেট চেম্বারে যেতে চায় না। সরকারি চিকিৎসা নিচ্ছে।

টিবি হাসপাতালে ভর্তি রোগী বেড়ে দ্বিগুণ : রাজধানীর শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালেও ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগী ছিল ১৭৯ জন। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৫৬ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩২৪ ও ৩৪৭ জন। বেড়েছে বহির্বিভাগের রোগীও।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় সাত হাজার ২৭৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ছয় হাজার ১৩৬ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চিকিৎসা নেয় আট হাজার ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ছয় হাজার ৮৭৯ জন। এই সংখ্যা মার্চে আরো বেশি বলেও জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. হোসেন (২৫) বলেন, তিন দিন ধরে কাশি বেড়েছে। মাঝেমধ্যে নাক দিয়ে ও কাশির সঙ্গে রক্ত যায়। তাই দেরি না করে হাসপাতালে চলে এসেছি।

হোসেনের মতো এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রেহেনা (৪২) বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারি না। রাত হলে কাশি বেড়ে যায়। কাশতে কাশতে সারা শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। ওষুধ অনেক খেয়েছি। কোনো কাজ হয় না।

হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. এহসানুল কবীর বলেন, সাধারণত শীতের সময় অনেক প্রেসারের রোগীর নাক দিয়ে রক্ত যায়। ওষুধে এটি আবার সেরেও যায়। যাদের ১৪ দিনের বেশি কাশি থাকছে, তাদের যক্ষ্মার টেস্ট দিচ্ছি। যাদের ফুসফুসের ইনফেকশন বা নিউমোনিয়ার সমস্যা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের বুকের এক্স-রে করাতে বলছি। এতে বোঝা যায়, তিনি কভিডজনিত ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন না অন্য কোনো সমস্যা থেকে হচ্ছে।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কভিড এখনো যায়নি, কিন্তু আমরা বেশির ভাগই মাস্ক পরা, হাত ধোয়া কমিয়ে দিয়েছি। এর সঙ্গে ঢাকা শহরের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ধুলাবালি ও বায়ুদূষণ বেড়েছে। তাই অ্যাজমাসহ দীর্ঘমেয়াদি কাশি, নিউমোনিয়া রোগের প্রবণতা বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের রোগী বাড়ে। তবে এ বছর অনেক বেশি। বিশেষ করে বাচ্চা বা বয়স্ক মানুষের সমস্যাটা বেশি। তাই কভিড থেকে সেরে ওঠার পরও যারা দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছে, যাদের বার্ধক্যজনিত জটিল রোগ বা কমরবিডিটি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/03/12/1260178