১২ মার্চ ২০২৩, রবিবার, ১২:৪৩

খুচরা বিক্রেতাদের প্রায় দ্বিগুণ লাভের সুযোগ

বিভিন্ন কম্পানি ৫০০ মিলিলিটারের বোতলজাত খাওয়ার পানির দাম বাড়িয়ে খুচরা বিক্রেতাদের প্রায় দ্বিগুণ লাভের সুযোগ করে দিয়েছে। সম্প্রতি এসব পানির বোতলের দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা করেছে বেশির ভাগ কম্পানি।

পানিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দাম বাড়ানোর এই বিষয়টি অস্বাভাবিক। কম্পানিগুলো নিজ নিজ পানির বোতল কেনায় খুচরা বিক্রেতাদের উৎসাহদানে এই উদ্যোগ নিয়েছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ধানমণ্ডি, গুলশান, ভাটারা থানার আশপাশে দেখা গেছে, খুচরা দোকানে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, কোকা-কোলা কম্পানির কিনলে, পেপসিকো কম্পানির অ্যাকুয়াফিনা পানির বোতল।

খুচরা বিক্রেতাদের তথ্য মতে, এগুলোর মধ্যে ফ্রেশ কম্পানির আধালিটার পানির বোতলের ২৪টির এক কেসের দাম আগে ১৯০ টাকা ছিল, এখন তা ২৫০ টাকা করা হয়েছে। এতে ফ্রেশ কম্পানির কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতাদের প্রতি বোতল পানি কিনতে লাগে ১০ টাকা ৪১ পয়সা। একই ভাবে অ্যাকুয়াফিনার এক কেস পানির বোতলের দাম ২৫৫ টাকা। তাদের প্রতি বোতলের দাম পড়ে ১০ টাকা ৬২ পয়সা। কিনলের আধালিটারের পানির বোতল প্রতি কেস ২৮০ টাকা। এতে প্রতিটির দাম পড়ে ১১ টাকা ৬৭ পয়সা। এসব কম্পানির মধ্যে গায়ের মূল্যের চেয়ে কম্পানির দামের পার্থক্য সবচেয়ে কম পারটেক্স গ্রুপের মাম পানির। এ জন্য খুচরা দোকানে এই কম্পানির পানি সবচেয়ে কম দেখা গেছে। মাম পানির ৩৩০ মিলিলিটারের ২৪টি বোতলের এক কেসের দাম ১৮০ টাকা। এতে কম্পানি প্রতি বোতলের দাম ধরে সাত টাকা পাঁচ পয়সা। বোতলের গায়ে মূল্য দেওয়া আছে ১০ টাকা।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ৫০০ মিলিলিটারের এক বোতল মাম পানির দামও ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হবে বলে আভাস দিয়েছেন কম্পানির বিক্রয়কর্মীরা। বাজারে বর্তমানে আগের উৎপাদিত পানিই পাওয়া গেছে। সেগুলোর এক কেসের দাম ২৪৫ টাকা। এতে দাম পড়ে ১০ টাকা ২০ পয়সা। আর বোতলের গায়ের দাম ১৫ টাকা। তবে বোতলের গায়ের দাম ২০ টাকা করা হলে ২৪টির এক কেসের দাম ৩০০ টাকার ওপরে ধরা হবে বলে জানিয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা।

খুচরা দোকানিদের দেওয়া তথ্য মতে, আধালিটার বোতলের ফ্রেশ পানি বিক্রি করে লাভ হয় ৯ টাকা ৫৯ পয়সা, অ্যাকুয়াফিনায় ৯ টাকা ৩৭ পয়সা, কিনলেতে আট টাকা ৩৩ পয়সা, মামে লাভ পাঁচ টাকা। তাঁরা বলছেন, মাম পানিতে গায়ের মূল্যের চেয়ে কম্পানির দামের পার্থক্য সবচেয়ে কম থাকায় তাঁরা এই কম্পানির পানি দোকানে কম রাখেন বা নিতেই চান না।

খুচরা দোকানিদের লাভের অঙ্ক হিসাব করে পাওয়া গেছে, ফ্রেশ কম্পানির আধালিটার পানিতে লাভ প্রায় ৪৮ শতাংশ, অ্যাকুয়াফিনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ, কিনলেতে ৪২ শতাংশ আর মামে লাভ প্রায় ৩৩ শতাংশ।

ভাটারা থানার পাশে মাদানি রোডের ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো. মফিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৫ টাকা দাম থাকা অবস্থায় আধালিটারের ২৪টি বোতলের দাম কম্পানি ধরত ২০০ টাকা। প্রতি বোতলের দাম আট টাকা ৩৩ পয়সা। এখন আবার দাম বাড়িয়েছে। পানি দোকানে রাখলে কিন্তু লাভ ডাবল, দাম বাড়ানোর পরও। মাম পানি ২৪৫ টাকা ২৪টির কেস। এগুলোর গায়ের দাম ১৫ টাকা। কম্পানি বলেছে দাম বাড়াবে। মানুষ তো ব্র্যান্ড বোঝে না। যেটা কম দামে পায়, সে পানিই কেনে। সব কিছুর দাম বাড়ায় তারা দোকানে এসে একটু কম দামের পানি খোঁজে। যে পানি কম দামে পায়, সেটাই নিয়ে নেয়।
এসব কম্পানি ছাড়াও খুচরা বাজারে আকিজ গ্রুপের রিভেরা ও স্পা, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ ড্রিংকিং ওয়াটার, সিটি গ্রুপের জীবন, টিকে গ্রুপের পুষ্টি পানি দেখা গেছে।

পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পক্ষ থেকে জানানো হয়, সারা দেশে অন্তত ৪৫টি কম্পানি বোতলজাত পানি বিক্রি করে। এর মধ্যে ৩৫টি কম্পানিই ঢাকাকেন্দ্রিক। এসব কম্পানি সাধারণত আধালিটার, এক লিটার, দুই লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতলে খাওয়ার পানি সরবরাহ করে। এ ছাড়া বড় জারে স্কুল-কলেজ, পার্ক, বাসা, অফিস, হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানি সরবরাহ করে অন্তত ১৫০টি কম্পানি।

বিএসটিআইয়ের মুখপাত্র ও উপপরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শুধু পণ্যের মান নির্ধারণ করি, কিন্তু এর দাম ঠিক করে দিই না। দাম নির্ধারণ করে উৎপাদিত পণ্যের কম্পানিগুলো।’

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কম্পানিগুলো পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়ালেও তা দেখার জন্য সরকারের এমন কোনো সংস্থা নেই, যারা এগুলোর তদারকি করবে। জ্বালানির দাম বাড়ালে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। সরকারের উচিত ছিল যেসব প্রধান পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, সেখানে সতর্কতা অবলম্বন করা। তাহলে দেখা যেত ঢালাওভাবে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা সবাই করতে পারছে না। দেশের অসম প্রতিযোগিতা দেখা দিলে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা মামলাও করতে পারে।

খুচরা বিক্রেতাদের ৩৩ থেকে ৪৮ শতাংশ লাভ দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উপপরিচালক (সিনিয়র সহকারী সচিব) র হ ম আলাওল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, পানির দামটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টি আমাদের কমিশন দেখে। আমাদের কমিশনে দুইভাবে মামলা করা যায়। দেশের যেকোনো নাগরিক যেকোনো বিষয়ে মামলা করতে পারে। আরেকটি কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করতে পারে। যেমন—টিভি, পত্রিকা বা অনলাইনে নিউজ দেখে মামলা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কমিশনকে অবারিত সুযোগ দেওয়া আছে। আমাদের প্রয়োগের ক্ষেত্র ব্যাপক। কোথাও যদি মনোপলি হয়, তাহলে কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে। পানির দামের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে।

চেয়ারম্যান স্যার বলেছেন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সম্প্রতি কমিশনে বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে যদি পানির বিষয়টি থাকে, কম্পানিগুলোকে ডাকা হবে। জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/03/12/1260173