১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:০৪

নিরাপত্তা তদারকির দায়িত্ব শুধু কাগজে, বাস্তবে নখদন্তহীন

দেশের সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারক করার প্রধান দায়িত্ব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই)। শ্রমিক-কর্মচারীদের আইনগত অধিকার, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা এ সংস্থার। তবে দেশে ২৫ লাখের বেশি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিদর্শক রয়েছেন ৪০০-এরও কম। তা ছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এ সংস্থাটি নখদন্তহীন। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় ঝুঁকি দেখলেও কারখানা বন্ধ তো দূরের কথা, বড় ধরনের জরিমানা আদায়ের ক্ষমতাও নেই তাদের। বড়জোর একটি সতর্কতা নোটিশ দিতে পারে।

ডিআইএফইর নেই কারিগরি দক্ষতা। আছে আইনি দুর্বলতা। অন্যদিকে তাদের জবাবদিহিরও কোনো বালাই নেই। বিদ্যমান জনবল ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাটি নিজেই এক ধরনের অসহায়ত্বের মধ্যে আছে।

গত বছর শ্রম আইন সংশোধন করলেও এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। পরিদর্শনে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে জরিমানা আদায় কিংবা কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল ডিআইএফইর পক্ষ থেকে। তা দেওয়া হয়নি। নতুন করে শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে। এবারও একই প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

শ্রম আইনে বলা হয়েছে, শ্রম নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারা অমান্য করলে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। গুরুতর অনিয়মের কারণে মাত্র ১০ টাকা জরিমানা করার নজিরও আছে। নামমাত্র জরিমানা করায় নিরাপত্তার তোয়াক্কা করছেন না কারখানা মালিকরা। তবে কোনো স্থাপনায় বড় অনিয়ম পেলে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে ডিআইএফই।

এ ছাড়া রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এখন নিরাপত্তা নিয়ে আগের মতো উদ্বেগ কিংবা সংস্কারে কোনো ধরনের চাপও নেই। ফলে জবাবদিহি ও নজরদারিবিহীন পরিবেশে যেনতেনভাবে শিল্পকারখানা এবং বাণিজ্য স্থাপনা নির্মাণ ও কার্যক্রম পরিচালনায় মালিকদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এ কারণে উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে যুগের পর যুগ চলছে দেশের ছোট-বড় সব শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। পরিণামে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা। মারা যাচ্ছেন শ্রমিক-কর্মচারী।

প্রতি পরিদর্শকের বিপরীতে ৬৪৬৫ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার ৭৫৩ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন এসব প্রতিষ্ঠানে। বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠান তদারকির জন্য সারাদেশে ৩১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে ডিআইএফইর মাত্র ৩৯৩ জন পরিদর্শক রয়েছে। এ হিসাবে প্রতি পরিদর্শকের বিপরীতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬ হাজার ৪৬৫টি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ডিআইএফইর লোকবল বাড়ানোর নির্দেশনা দেন। এরপর ২ হাজার ৭০০ পরিদর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় পাঁচ বছর আগে। লোকবল চেয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া পদোন্নতি-বঞ্চিত রয়েছে ১৫০ জন কর্মকর্তা। সূত্র জানিয়েছে, পদোন্নতি না পাওয়ায় কাজে মনোযোগ নেই কর্মকর্তাদের। একই পদ থেকে অবসরে যাওয়ার নজিরও আছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেও নিয়োগ-পদোন্নতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে।

সূত্র জানিয়েছে, একই কারণে তৈরি পোশাকের জন্য গঠিত আরএমজি কো-অর্ডিনেশন সেলও (আরসিসি) কার্যকর কিছু করতে পারেনি। রানা প্লাজা ধসের পর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আর্থিক সহায়তায় এ সেল গঠন করা হয়। পোশাক খাতের ইউরোপ ও আমেরিকার দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের আওতার বাইরে থাকা ৯০০ কারখানার নিরাপত্তা উন্নয়নের দায়িত্ব আরসিসির।

অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলো শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও এই ৯০০ কারখানায় এখনও নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়ে গেছে। ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিট নামে আলাদা ইউনিট গঠনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চাপ আছে। এ বিষয়ে অর্গানোগ্রামসহ ডিআইএফইর প্রস্তাবের কোনো অগ্রগতি নেই।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউটস অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, গত সাত বছরে ছোট-বড় মিলে দেশে ১ লাখ ২৪ হাজার ১৭৫টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭৫৩ জন। সম্পদহানির পরিমাণ ২ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। শিল্পকারখানা, বহুতল অফিস ভবন, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমলে নেওয়া হয়েছে।

ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক নাসির উদ্দিন দেশের বাইরে থাকায় এসব বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ করা হলে একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রধান দায়িত্ব ডিআইএফইর। তবে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং বিভাগ যেমন– ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনবিআর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগও একই সঙ্গে দায়িত্বশীল। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কারখানাকে লাইসেন্স কিংবা অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিআইএফইর লাইসেন্স আছে কিনা, তা যাচাই করে না।

দেশের শিল্পকারখানার নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে– জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, ডিআইএফইর জনবল বাড়ানো, প্রযুক্তি সুবিধা দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব পর্যায়ে তাদের শক্তিশালী করতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ডিআইএফইকে। বেসরকারি পর্যায় থেকে গবেষণা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2303161477