১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:০৩

চরম ঝুঁকিতে ৭০ ভাগ বেজমেন্ট

রাজধানীর পুরান ঢাকার ভবনগুলোর বেজমেন্টের ৭০ শতাংশ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য কাজে। বেজমেন্টে গড়ে তোলা হয়েছে প্লাস্টিকের গোডাউন, দোকানপাট, দাহ্য পদার্থের কারখানা ইত্যাদি। আছে বয়লারও। আবার কোথাও রয়েছে খাবার হোটেল। গ্যাসের সিলিন্ডারে বা অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে আগুন জ্বালানো হচ্ছে। এসব কারণে বেজমেন্টগুলো নগরবাসীর জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

এসব বেজমেন্ট থেকে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। কিছু বেজমেন্টের অবস্থা এত বাজে যে তাতে কী জিনিসপত্র আছে, তাও বোঝার উপায় নেই। বিভিন্ন ধরনের তার-পাইপ জড়িয়ে-পেঁচিয়ে জঞ্জালে পরিণত হয়েছে কিছু বেজমেন্ট।
ভবনগুলোর তদারককারী সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কখনও বেজমেন্টের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আজ এ অবস্থা। অথচ প্রায় সব ভবন মালিকই বিত্তশালী। তারপরও বেজমেন্টগুলো তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করছেন। একজন সংসদ সদস্যের ভবনের বেজমেন্টও এ তালিকায় রয়েছে। সেটা গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর রাজউক নড়েচড়ে বসেছে। রাজউকের অঞ্চলগুলোর প্রত্যেক পরিচালককে আহ্বায়ক করে আটটি কমিটি করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অথরাইজড অফিসার, ইমারত পরিদর্শক, প্রধান ইমারত পরিদর্শক ও সহকারী অথরাইজ অফিসারকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। শুক্র ও শনিবারের ছুটিও বাতিল করে সংশ্লিষ্টদের ১৫ মার্চের মধ্যে বেজমেন্টগুলো ব্যবহারের চিত্র সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চল থেকে তিনটি টিম করে শুক্রবার কাজ শুরু হয়েছে।

৭ নম্বর অঞ্চলের (পুরান ঢাকা) অথরাইজড অফিসার মাকিদ এহসান সমকালকে জানান, প্রথম দিন তাঁরা ৫৪টি ভবনের বেজমেন্ট পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু অবস্থা খুবই নাজুক। প্রায় ৭০ শতাংশ ভবনের বেজমেন্টের অবস্থা ভালো না। পার্কিং ছাড়া কারখানা-গোডাউন-হোটেল বা অন্য কাজে বেজমেন্ট ব্যবহৃত হলে তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুরান ঢাকায় এই চিত্রটা খুবই ভয়ংকর।

তিনি জানান, বংশাল এলাকার ২০টি ভবনের মধ্যে মাত্র একটির বেজমেন্টের সঠিক ব্যবহার পাওয়া গেছে। অনেকে নকশা দেখাতে পারেননি। অনেকে কথাও বলতে চাইছেন না। অনেক মালিককে ভবনে পাওয়া যায়নি।

রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস সমকালকে বলেন, মালিকরা বেজমেন্টভিত্তিক কী ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাঁদের অনুমোদন আছে কিনা, সেগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। আটটি অঞ্চলে ২৪টি টিম কাজ করছে। প্রথম দিন কতগুলো বেজমেন্ট পরিদর্শন করল, একদিন পর রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তবে পুরান ঢাকার অবস্থা ভালো নয়।

আজ শনিবার নগর-সংক্রান্ত সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’র মিটিং ডাকা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য সচিব রাজউক চেয়ারম্যান ও আহ্বায়ক পূর্ত সচিব। এ ছাড়া বুয়েট, স্থাপত্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্বরা রয়েছেন। কমিটির মিটিং থেকে পাওয়া সুপারিশ অনুযায়ী পরে রাজউক ওইসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

নগর উন্নয়ন কমিটির সাবেক সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ সমকালকে বলেন, পুরান ঢাকার শতভাগ বেজমেন্টই ঝুঁকিপূর্ণ। নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি এ কারণেই ঘটেছে। কিছু মানুষের লোভের কারণে অনেক মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। চুড়িহাট্টার পর যে সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব গুদাম-কারখানা সরানোর কোনো বিকল্প নেই। এতে কারও কারও ব্যক্তিগত ক্ষতি হতে পারে কিন্তু নগরবাসী উপকৃত হবে। তা না হলে যে কোনো মুহূর্তে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভবনের কোথায় কোথায় কী ধরনের ব্যত্যয় আছে, তা চিহ্নিত করে শুধরাতে ভবন মালিককে বাধ্য করতে হবে।

শুক্রবার নবাবপুর রোডের ২১ আব্দুল হামিদ লেনের ছয়তলা ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বেজমেন্টে মেশিনারি, স্যানিটারি, ইলেকট্রনিকের দোকান আর গোডাউন। ভবনের নকশা আছে কিনা বলতে চাননি মালিক লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, এ এলাকার সব ভবনের নিচতলা-বেজমেন্টে দোকান-গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সে অনুযায়ী তিনিও দোকান ও গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন।

নবাবপুর রোডের মদন পাল লেনের ১০৭-১০৮ হোল্ডিংয়ের মদিনা আয়জু কমপ্লেক্সটির মালিক ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ১০ তলা ভবনটির বেজমেন্টে বিয়ারিং পার্টস আর মেশিনারিজের গোডাউন।

বংশাল আলুবাজার ৫/৭ হাজী ওসমান রোডের সাততলা মাজেদ সরকার টাওয়ারের বেজমেন্টকে বানানো হয়েছে লোহার পাইপ আর স্যানিটারি মালপত্রের গোডাউন ও দোকান। এ সড়কের ছয়তলা সিদ্দিকবাজার জামে মসজিদ ভবনের বেজমেন্টে রয়েছে সেচ, কৃষিপণ্য ও স্যানিটারি পণ্যের গোডাউন।

সূত্রাপুরের জাস্টিস লাল মোহন দাস লেনের ৩৯/৬ এবং ৩৯/৭ হোল্ডিংয়ের চারতলা ভবনটির বেজমেন্টে বুক বাইন্ডিংয়ের কারখানা। ভবনটির মালিক গোলাম কাদের ভবনের নির্মাণসংক্রান্ত কোনো নকশার কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। কাঠেরপুল এলাকার ২৯/১ তনুগঞ্জ লেনের পাঁচতলার বেজমেন্টও চলছে বুক বাইন্ডিংয়ের কাজ।

রাজউকের টিমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, নবাবপুর রোডের ১২৭/৩২ নম্বর, ১৯৮-২০২ নম্বর হোল্ডিংয়ের বেজমেন্টে রয়েছে মেশিনারিজ আইটেমের গোডাউন। ৫২ নর্থসাউথ রোডের দ্বীন সুপার মার্কেট, ৪ নম্বর সিদ্দিকবাজারের টিএ প্লাজা, ৫নং সিদ্দিকবাজারের আয়শা প্লাজার বেজমেন্টে রয়েছে স্যানিটারির গোডাউন। ৩৯/৬ ও ৩৯/৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের বেজমেন্টে চলছে বই বাঁধানোর কাজ।

১৩৭ হাজী ওসমান গণি রোডর ভবনটিতে রয়েছে বয়লার ও স্যানিটারি গোডাউন। ১৪৫/১৪৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে চলছে পাইপ ফিটিংসের কাজ ও রয়েছে স্যানিটারির গোডাউন।

রাজউকের পরিচালক হামিদুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শনে আমরা কী পেলাম, তা এখনই গণমাধ্যমকে জানাচ্ছি না। ১৫ মার্চের পর রাজউক কর্তৃপক্ষই সবাইকে জানাবে।

https://samakal.com/capital/article/2303161485